ড. ইউনূসের সামাজিক উদ্যোগ বনাম রাষ্ট্রের সৃজনশীলতা
Sat, 23/04/2011
এক. সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বয়স অতিক্রান্ত হওয়ার কারণে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অব্যাহতি প্রদান করে। সরকারের এই আদেশের বিরুদ্ধে ড. ইউনূস এবং ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের ৯ জন নারী সদস্য হাইকোর্ট বিভাগে দুটি রিট দাখিল করেন। হাইকোর্ট বিভাগ দুটি রিটই খারিজ করে দিলে তারা ন্যায়বিচারের প্রত্যাশায় আপিল বিভাগের দ্বারস্থ হন। কিন্তু সেখান থেকেও একটি আপিল খারিজ হয়ে যায়। অন্যটি বিচারাধীন। তবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পক্ষে রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীরা জোরালোভাবে লেখালেখি ও বক্তৃতা-বিবৃতি অব্যাহত রেখেছেন। যদিও বিপক্ষের বুদ্ধিজীবীরা বহু আগে থেকেই গ্রামীণ ব্যাংকের ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমে সুদের পরিমাণ ও আদায় পদ্ধতি এবং ড. ইউনূসের সামাজিক ব্যবসাকে সমালোচনার দৃষ্টিতে মূল্যায়ন করে আসছেন। উভয়পক্ষের বক্তব্যে দারিদ্র্য হ্রাসকরণে গ্রামীণ ব্যাংকের অবদান ও রাষ্ট্রের মুখপাত্র হিসেবে সরকারের ইতিবাচক/নেতিবাচক ভূমিকাসহ অনেক কিছু উঠে এসেছে। আমরা জানি, রাষ্ট্র একটি রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মাইকেল মান মনে করেন, সমাজের অন্য সব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে রাষ্ট্রের পার্থক্য হলো_ এর রয়েছে কেন্দ্রীকতা (Centrality) যা তাকে সব কাজের মধ্যমণি করে রাখে। আরও রয়েছে রাজ্যিকতা (Territoriality) যা তাকে অন্য যে কোনো প্রতিষ্ঠানের ওপর ক্ষমতা বিস্তারের সুযোগ করে দেয়। অন্যদিকে ‘দারিদ্র্যের দর্শন’ গ্রন্থের লেখক নিরাষ্ট্রবাদী দার্শনিক পিয়েরে যোসেফের মতে, রাষ্ট্র নিজেই সমস্যা। তাই কোনো কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের পরিবর্তে প্রয়োজন, স্বতঃস্ফূর্ত শৃংখলা যা থেকে তৈরি হবে সামাজিক সংস্থা। তিনি আরও মনে করেন, একমাত্র ব্যবসায়িক লেনদেনের মাধ্যমে গড়ে উঠবে সামাজিক শৃংখলা। আমরা লক্ষ্য করি, দারিদ্র্য হ্রাসে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সামাজিক ব্যবসা ইতিবাচক নিরাষ্ট্রবাদী দর্শনের একটি আধুনিক রূপ যা আন্তর্জাতিক সমাজের সমর্থন নিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সঙ্গে অধুনা বিরোধে লিপ্ত। এমতাবস্থায়, রাষ্ট্রকে সৃজনশীল পদ্ধতি প্রয়োগে মনোযোগী হওয়ার পরামর্শ দেওয়া ঠিক হবে, নাকি এর বিপরীতে সমাধান হিসেবে সামাজিক উদ্যোগকে বেশি মাত্রায় উৎসাহিত করা উচিত হবে? অথবা, সামাজিক উদ্যোগ ও রাষ্ট্রের সৃজনশীলতা উভয়কেই স্ব স্ব পথে পরিচালিত হওয়ার জন্য তাগিদ দিতে হবে?
দুই. বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সিপিডি’র চেয়ারম্যান প্রফেসর রেহমান সোবহান ‘চাই রাষ্ট্রনায়কোচিত প্রজ্ঞা’ শীর্ষক কলামে বলেছেন- ‘১৯৮৩ সালে গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশ কার্যকর করা এবং ১ দশমিক ৮ কোটি টাকা মূলধন দেওয়া ছাড়া গত ৩০ বছরে সরকারের সহযোগিতা উল্লেখ করার মতো নয়। গ্রামীণ ব্যাংক ঋণের মাধ্যমে বাণিজ্যিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যাংক থেকে যে পুঁজি সংগ্রহ করেছে তা যথাসময়ে পরিশোধ করেছে। অথচ বহু অভিজাত গ্রহীতা ব্যাংকের বিপুল পরিমাণ টাকা আত্মসাৎ করেছে। তিনি দরিদ্রদের জন্য এনজিও বানানোর বদলে একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করেছেন। তার আশা ছিল সরকারও তার উদ্যোগের সঙ্গে অংশীদার হবে। গত ৩০ বছরে গ্রামীণ ব্যাংক কোটি কোটি দরিদ্র নারীকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ঋণগ্রহীতা বানিয়েছে, যাকে পর্বতপ্রমাণ সাফল্যের সঙ্গে তুলনা করা যায়। ড. মুহাম্মদ ইউনূস শুধু দেশের মধ্যে নয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়েও সম্মানিত ব্যক্তি। তিনি ফরচুন (সৌভাগ্যবান) ৫০০ তালিকাভুক্ত যে কোনো সিইও’র সঙ্গে ফোন তুলেই কথা বলতে পারেন এবং যে কোনো কর্পোরেট বিনিয়োগকারীদের নিকট থেকে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করার যোগ্যতা রাখেন। তার গ্রামীণ মডেল পৃথিবীর সর্বত্র অনুসৃত হচ্ছে। তার মধ্যে কয়েকটি সমাজতান্ত্রিক দেশও রয়েছে। বর্তমানে তার পুনর্নিয়োগের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। কিন্তু ১৯৯৯ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত দুটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার, ৩টি গণতান্ত্রিক সরকার ও ৪ জন গভর্নর কেউই এ বিষয়ে প্রশ্ন তোলেন নি। এখন প্রশ্ন তোলা হয়েছে, তার বয়স ৭০ পেরিয়েছে। সে মোতাবেক প্রধানমন্ত্রী, পরিকল্পনামন্ত্রী, অর্থমন্ত্রীসহ অনেকেরই অবসরে যাওয়ার কথা। তাকে ব্যাংক থেকে বিদায় করার আগে তার সুখ্যাতি, কর্মোদ্যম, যোগ্যতা এবং নামের কর্পোরেট মূল্য বিবেচনায় নেওয়া উচিত। তাকে প্রতিপক্ষ না মনে করে প্রধানমন্ত্রীর উচিত সমঝোতা করা। যেহেতু আমাদের প্রধানমন্ত্রী নারী এবং যার পক্ষে গ্রামীণ ব্যাংকের মালিক কোটি কোটি নারীর উদ্বেগের প্রতি অসহিষ্ণু হওয়া কিংবা তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার রাজনৈতিক পরিণতি বহন করা কঠিন, যে কষ্টকর পদে তিনি অভ্যন্তরীণভাবে রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক স্তরে কূটনৈতিক সাফল্য অর্জন করেছেন, সেই অর্জনকে এমন একটি ইস্যুতে খুইয়ে ফেলা ঠিক হবে না’ (প্রথম আলো, ১৯ মার্চ ‘১১)। এর বাইরেও ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পক্ষে আরও কয়েকজন লেখক বলেছেন- ‘২০০৭ সালে তিনি একটি রাজনৈতিক দল গঠন করে বিদ্যমান দ্বিদলীয় ব্যবস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে চেয়েছিলেন। তার জন্য বর্তমান সরকার তাকে এভাবে হেনস্থা করছে।’
তিন. আবার ওসবের বিপরীত যুক্তি পাই সাংবাদিক ও কথা সাহিত্যিক রাহাত খানের এক কলামে। তিনি ‘ড. ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা নন’ শীর্ষক কলামে বলেছেন- ‘দেশের প্রচলিত আইন এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রবিধান ও তদারকির আওতায় একটি বিশেষায়িত ব্যাংক হিসেবে ড. ইউনূসকে প্রতিষ্ঠাতা বলা যায় না। তবে তাকে ম্যানেজিং ডাইরেক্টর পর্যন্ত বলা যেতে পারে। … … তার অবর্তমানে নেতৃত্ব তৈরির ক্ষেত্রে তার কার্পণ্য লক্ষণীয়। অনেকেই মনে করতেন, দীপাল বড়ুয়া অথবা খালেদ সামস্ তার পরে এমডি পদে অধিষ্ঠিত হবেন। কিন্তু রহস্যজনক কারণে উভয়কে সরিয়ে দেয়া হয়। বহির্দেশীয় ব্যবসায়ীদের তার প্রতি আকর্ষণের মূলে রয়েছে ব্যবসায়িক স্বার্থ। যেমন_ গ্রামীণ ব্যাংককে কো-লেটারাল বা ইক্যুইটি দিতে হয় না। ট্যাক্স দিতে হয় না। তিনি শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন, কিন্তু উচ্চহারের সুদের বিনিময়ে ঋণ দিয়ে কীভাবে শান্তি প্রতিষ্ঠা করলেন তা বিবেচনার দাবি রাখে।
চার. ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংকের কার্যক্রম সম্পর্কিত মতামতগুলোকে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করা যায়। সমাজতান্ত্রিক ভাবাদর্শীরা মনে করেন- ‘গ্রামীণ ব্যাংক দারিদ্র্য বিমোচনের নামে শোষিত মানুষের প্রতিবাদী চেতনাকে ধ্বংস করছে।’ মহাজোট সরকারের বামপন্থি শরিক দলগুলোর বক্তব্যেও এরূপ সুর পরিলক্ষিত হয়। ডানপন্থিদের বক্তব্য হলো- ‘গ্রামীণ ব্যাংক সুদের কারবার করছে। ধর্মে সুদকে হারাম করা হয়েছে।’ আবার মধ্যডানের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ড. ইউনূসের পক্ষে বিবৃতি দিতে শুরু করায় ডানপন্থি পত্রিকাগুলো এখন সুর পাল্টে সুদের বিরুদ্ধে লিখছে না। অন্যদিকে মধ্য বামের প্রধান দল আওয়ামী লীগের নেতারা গ্রামীণ ব্যাংকের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যের পর সবাই একই সুরে কথা বলছেন। উপরোক্ত মূল্যায়নের বাইরে আমরা একটি দেশের আর্থ-সামাজিক সেক্টরগুলোকে তিন শ্রেণীতে বিভক্ত করে কিছু বলতে পারি। রাষ্ট্রের প্রথম সেক্টর হলো_ সরকার ও তার নিয়ন্ত্রিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান (যেমন সরকারি-আধা সরকারি অফিস, ব্যাংক-বীমা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি)। দ্বিতীয় সেক্টর হলো_ কর্পোরেট ব্যবসায়ী ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহ। আর তৃতীয় সেক্টর হলো_ এনজিও কার্যক্রম। গ্রামীণ ব্যাংক যদি প্রথম সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত হয় তাহলে ব্যাংকের নীতিমালা বিনা প্রশ্নে মেনে নিতে হবে। আর যদি দ্বিতীয় সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত হয় তাহলে গ্রামীণ ব্যাংককে ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঘোষণা দিতে হবে। আর যদি তৃতীয় সেক্টরভুক্ত মনে করে, তাহলে নিজেকে এনজিও ব্যুরো অথবা সমাজসেবা অধিদপ্তরে নিবন্ধিত হতে হবে। কিন্তু বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে প্রমাণিত হয়েছে, ড. মুহাম্মদ ইউনূস তার গ্রামীণ ব্যাংক ও সামাজিক উদ্যোগসমূহকে তিনটি সেক্টরের কোনোটিরই অন্তর্ভুক্ত বলে মনে করেন না। তবে রাষ্ট্রের আইন-কানুনকে (রেগুলেশন) তিনি সবসময় তার কাজের ক্ষেত্রে বাধা মনে করে উপেক্ষা করতে চেয়েছেন।
পাঁচ. গ্রামীণ ব্যাংক প্রধানত গ্রামের দুস্থ নারীদের লক্ষ্য করে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। এই মেয়েরা কোনো না কোনো গ্রামীণ স্থানীয় ইউনিটে বসবাস করে। দুস্থ মহিলাদের উন্নয়নের জন্য স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রম রয়েছে। সেজন্য বিভিন্ন এনজিও স্থানীয় সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে তাদের প্রকল্প বাস্তবায়ন করে থাকে (যদিও তা অনেকটা দায়সারা গোছের)। অথচ স্থানীয় সরকারের সঙ্গে গ্রামীণ ব্যাংকের কোনো সম্পর্ক নেই। গ্রামীণ ব্যাংক স্থানীয় সরকারকে কোনো ভবন ট্যাক্স দেয় না। এটিকে অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখিয়ে সরকার থেকে ভবন ট্যাক্স মওকুফ করে নেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে, ইউনিয়ন পরিষদকে ১০টি বাধ্যতামূলক ও ৩৮টি ঐচ্ছিক দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এ দায়িত্বগুলো পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে এনজিওদের কাজ করার কোনো জায়গা থাকবে না। ছয়. এখন প্রশ্ন হলো_ ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি পদ থেকে অপসারণ করলেই কি উচ্চহারে সুদ আদায় বন্ধ হবে? সেজন্য সরকারের কাজ হবে সময়োপযোগী সমাধান খুঁজে বের করা। তবে বিলম্বে হলেও সরকার এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, ভবিষ্যতে ক্ষুদ্রঋণের পরিশোধিত টাকার ওপর কোনো সুদ দিতে হবে না। ফলে সুদের হার দাঁড়াবে ২৭ শতাংশে, আগে যা ৪০ শতাংশে পেঁৗছাতো। এ বছরের জুন থেকে সরকারের এই নির্দেশ কার্যকর হবে।
লেখকবৃন্দ : প্রফেসর ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ, ডিরেক্টর-ইন-চার্জ, জাপান স্টাডি সেন্টার, ঢা. বি., ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান, সহযোগী অধ্যাপক, বিসিএস (শিক্ষা) এবং মোশাররফ হোসেন মুসা, সদস্য, সিডিএলজি।
Filed under: সংগ্রহ | Tagged: ড. ইউনূস | Leave a comment »