ড. ইউনূস

ড. ইউনূসের সামাজিক উদ্যোগ বনাম রাষ্ট্রের সৃজনশীলতা

Sat, 23/04/2011

এক. সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বয়স অতিক্রান্ত হওয়ার কারণে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অব্যাহতি প্রদান করে। সরকারের এই আদেশের বিরুদ্ধে ড. ইউনূস এবং ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের ৯ জন নারী সদস্য হাইকোর্ট বিভাগে দুটি রিট দাখিল করেন। হাইকোর্ট বিভাগ দুটি রিটই খারিজ করে দিলে তারা ন্যায়বিচারের প্রত্যাশায় আপিল বিভাগের দ্বারস্থ হন। কিন্তু সেখান থেকেও একটি আপিল খারিজ হয়ে যায়। অন্যটি বিচারাধীন। তবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পক্ষে রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীরা জোরালোভাবে লেখালেখি ও বক্তৃতা-বিবৃতি অব্যাহত রেখেছেন। যদিও বিপক্ষের বুদ্ধিজীবীরা বহু আগে থেকেই গ্রামীণ ব্যাংকের ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমে সুদের পরিমাণ ও আদায় পদ্ধতি এবং ড. ইউনূসের সামাজিক ব্যবসাকে সমালোচনার দৃষ্টিতে মূল্যায়ন করে আসছেন। উভয়পক্ষের বক্তব্যে দারিদ্র্য হ্রাসকরণে গ্রামীণ ব্যাংকের অবদান ও রাষ্ট্রের মুখপাত্র হিসেবে সরকারের ইতিবাচক/নেতিবাচক ভূমিকাসহ অনেক কিছু উঠে এসেছে। আমরা জানি, রাষ্ট্র একটি রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মাইকেল মান মনে করেন, সমাজের অন্য সব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে রাষ্ট্রের পার্থক্য হলো_ এর রয়েছে কেন্দ্রীকতা (Centrality) যা তাকে সব কাজের মধ্যমণি করে রাখে। আরও রয়েছে রাজ্যিকতা (Territoriality) যা তাকে অন্য যে কোনো প্রতিষ্ঠানের ওপর ক্ষমতা বিস্তারের সুযোগ করে দেয়। অন্যদিকে ‘দারিদ্র্যের দর্শন’ গ্রন্থের লেখক নিরাষ্ট্রবাদী দার্শনিক পিয়েরে যোসেফের মতে, রাষ্ট্র নিজেই সমস্যা। তাই কোনো কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের পরিবর্তে প্রয়োজন, স্বতঃস্ফূর্ত শৃংখলা যা থেকে তৈরি হবে সামাজিক সংস্থা। তিনি আরও মনে করেন, একমাত্র ব্যবসায়িক লেনদেনের মাধ্যমে গড়ে উঠবে সামাজিক শৃংখলা। আমরা লক্ষ্য করি, দারিদ্র্য হ্রাসে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সামাজিক ব্যবসা ইতিবাচক নিরাষ্ট্রবাদী দর্শনের একটি আধুনিক রূপ যা আন্তর্জাতিক সমাজের সমর্থন নিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সঙ্গে অধুনা বিরোধে লিপ্ত। এমতাবস্থায়, রাষ্ট্রকে সৃজনশীল পদ্ধতি প্রয়োগে মনোযোগী হওয়ার পরামর্শ দেওয়া ঠিক হবে, নাকি এর বিপরীতে সমাধান হিসেবে সামাজিক উদ্যোগকে বেশি মাত্রায় উৎসাহিত করা উচিত হবে? অথবা, সামাজিক উদ্যোগ ও রাষ্ট্রের সৃজনশীলতা উভয়কেই স্ব স্ব পথে পরিচালিত হওয়ার জন্য তাগিদ দিতে হবে?

দুই. বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সিপিডি’র চেয়ারম্যান প্রফেসর রেহমান সোবহান ‘চাই রাষ্ট্রনায়কোচিত প্রজ্ঞা’ শীর্ষক কলামে বলেছেন- ‘১৯৮৩ সালে গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশ কার্যকর করা এবং ১ দশমিক ৮ কোটি টাকা মূলধন দেওয়া ছাড়া গত ৩০ বছরে সরকারের সহযোগিতা উল্লেখ করার মতো নয়। গ্রামীণ ব্যাংক ঋণের মাধ্যমে বাণিজ্যিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যাংক থেকে যে পুঁজি সংগ্রহ করেছে তা যথাসময়ে পরিশোধ করেছে। অথচ বহু অভিজাত গ্রহীতা ব্যাংকের বিপুল পরিমাণ টাকা আত্মসাৎ করেছে। তিনি দরিদ্রদের জন্য এনজিও বানানোর বদলে একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করেছেন। তার আশা ছিল সরকারও তার উদ্যোগের সঙ্গে অংশীদার হবে। গত ৩০ বছরে গ্রামীণ ব্যাংক কোটি কোটি দরিদ্র নারীকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ঋণগ্রহীতা বানিয়েছে, যাকে পর্বতপ্রমাণ সাফল্যের সঙ্গে তুলনা করা যায়। ড. মুহাম্মদ ইউনূস শুধু দেশের মধ্যে নয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়েও সম্মানিত ব্যক্তি। তিনি ফরচুন (সৌভাগ্যবান) ৫০০ তালিকাভুক্ত যে কোনো সিইও’র সঙ্গে ফোন তুলেই কথা বলতে পারেন এবং যে কোনো কর্পোরেট বিনিয়োগকারীদের নিকট থেকে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করার যোগ্যতা রাখেন। তার গ্রামীণ মডেল পৃথিবীর সর্বত্র অনুসৃত হচ্ছে। তার মধ্যে কয়েকটি সমাজতান্ত্রিক দেশও রয়েছে। বর্তমানে তার পুনর্নিয়োগের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। কিন্তু ১৯৯৯ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত দুটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার, ৩টি গণতান্ত্রিক সরকার ও ৪ জন গভর্নর কেউই এ বিষয়ে প্রশ্ন তোলেন নি। এখন প্রশ্ন তোলা হয়েছে, তার বয়স ৭০ পেরিয়েছে। সে মোতাবেক প্রধানমন্ত্রী, পরিকল্পনামন্ত্রী, অর্থমন্ত্রীসহ অনেকেরই অবসরে যাওয়ার কথা। তাকে ব্যাংক থেকে বিদায় করার আগে তার সুখ্যাতি, কর্মোদ্যম, যোগ্যতা এবং নামের কর্পোরেট মূল্য বিবেচনায় নেওয়া উচিত। তাকে প্রতিপক্ষ না মনে করে প্রধানমন্ত্রীর উচিত সমঝোতা করা। যেহেতু আমাদের প্রধানমন্ত্রী নারী এবং যার পক্ষে গ্রামীণ ব্যাংকের মালিক কোটি কোটি নারীর উদ্বেগের প্রতি অসহিষ্ণু হওয়া কিংবা তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার রাজনৈতিক পরিণতি বহন করা কঠিন, যে কষ্টকর পদে তিনি অভ্যন্তরীণভাবে রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক স্তরে কূটনৈতিক সাফল্য অর্জন করেছেন, সেই অর্জনকে এমন একটি ইস্যুতে খুইয়ে ফেলা ঠিক হবে না’ (প্রথম আলো, ১৯ মার্চ ‘১১)। এর বাইরেও ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পক্ষে আরও কয়েকজন লেখক বলেছেন- ‘২০০৭ সালে তিনি একটি রাজনৈতিক দল গঠন করে বিদ্যমান দ্বিদলীয় ব্যবস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে চেয়েছিলেন। তার জন্য বর্তমান সরকার তাকে এভাবে হেনস্থা করছে।’

তিন. আবার ওসবের বিপরীত যুক্তি পাই সাংবাদিক ও কথা সাহিত্যিক রাহাত খানের এক কলামে। তিনি ‘ড. ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা নন’ শীর্ষক কলামে বলেছেন- ‘দেশের প্রচলিত আইন এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রবিধান ও তদারকির আওতায় একটি বিশেষায়িত ব্যাংক হিসেবে ড. ইউনূসকে প্রতিষ্ঠাতা বলা যায় না। তবে তাকে ম্যানেজিং ডাইরেক্টর পর্যন্ত বলা যেতে পারে। … … তার অবর্তমানে নেতৃত্ব তৈরির ক্ষেত্রে তার কার্পণ্য লক্ষণীয়। অনেকেই মনে করতেন, দীপাল বড়ুয়া অথবা খালেদ সামস্ তার পরে এমডি পদে অধিষ্ঠিত হবেন। কিন্তু রহস্যজনক কারণে উভয়কে সরিয়ে দেয়া হয়। বহির্দেশীয় ব্যবসায়ীদের তার প্রতি আকর্ষণের মূলে রয়েছে ব্যবসায়িক স্বার্থ। যেমন_ গ্রামীণ ব্যাংককে কো-লেটারাল বা ইক্যুইটি দিতে হয় না। ট্যাক্স দিতে হয় না। তিনি শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন, কিন্তু উচ্চহারের সুদের বিনিময়ে ঋণ দিয়ে কীভাবে শান্তি প্রতিষ্ঠা করলেন তা বিবেচনার দাবি রাখে।

চার. ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংকের কার্যক্রম সম্পর্কিত মতামতগুলোকে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করা যায়। সমাজতান্ত্রিক ভাবাদর্শীরা মনে করেন- ‘গ্রামীণ ব্যাংক দারিদ্র্য বিমোচনের নামে শোষিত মানুষের প্রতিবাদী চেতনাকে ধ্বংস করছে।’ মহাজোট সরকারের বামপন্থি শরিক দলগুলোর বক্তব্যেও এরূপ সুর পরিলক্ষিত হয়। ডানপন্থিদের বক্তব্য হলো- ‘গ্রামীণ ব্যাংক সুদের কারবার করছে। ধর্মে সুদকে হারাম করা হয়েছে।’ আবার মধ্যডানের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ড. ইউনূসের পক্ষে বিবৃতি দিতে শুরু করায় ডানপন্থি পত্রিকাগুলো এখন সুর পাল্টে সুদের বিরুদ্ধে লিখছে না। অন্যদিকে মধ্য বামের প্রধান দল আওয়ামী লীগের নেতারা গ্রামীণ ব্যাংকের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যের পর সবাই একই সুরে কথা বলছেন। উপরোক্ত মূল্যায়নের বাইরে আমরা একটি দেশের আর্থ-সামাজিক সেক্টরগুলোকে তিন শ্রেণীতে বিভক্ত করে কিছু বলতে পারি। রাষ্ট্রের প্রথম সেক্টর হলো_ সরকার ও তার নিয়ন্ত্রিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান (যেমন সরকারি-আধা সরকারি অফিস, ব্যাংক-বীমা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি)। দ্বিতীয় সেক্টর হলো_ কর্পোরেট ব্যবসায়ী ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহ। আর তৃতীয় সেক্টর হলো_ এনজিও কার্যক্রম। গ্রামীণ ব্যাংক যদি প্রথম সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত হয় তাহলে ব্যাংকের নীতিমালা বিনা প্রশ্নে মেনে নিতে হবে। আর যদি দ্বিতীয় সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত হয় তাহলে গ্রামীণ ব্যাংককে ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঘোষণা দিতে হবে। আর যদি তৃতীয় সেক্টরভুক্ত মনে করে, তাহলে নিজেকে এনজিও ব্যুরো অথবা সমাজসেবা অধিদপ্তরে নিবন্ধিত হতে হবে। কিন্তু বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে প্রমাণিত হয়েছে, ড. মুহাম্মদ ইউনূস তার গ্রামীণ ব্যাংক ও সামাজিক উদ্যোগসমূহকে তিনটি সেক্টরের কোনোটিরই অন্তর্ভুক্ত বলে মনে করেন না। তবে রাষ্ট্রের আইন-কানুনকে (রেগুলেশন) তিনি সবসময় তার কাজের ক্ষেত্রে বাধা মনে করে উপেক্ষা করতে চেয়েছেন।

পাঁচ. গ্রামীণ ব্যাংক প্রধানত গ্রামের দুস্থ নারীদের লক্ষ্য করে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। এই মেয়েরা কোনো না কোনো গ্রামীণ স্থানীয় ইউনিটে বসবাস করে। দুস্থ মহিলাদের উন্নয়নের জন্য স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রম রয়েছে। সেজন্য বিভিন্ন এনজিও স্থানীয় সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে তাদের প্রকল্প বাস্তবায়ন করে থাকে (যদিও তা অনেকটা দায়সারা গোছের)। অথচ স্থানীয় সরকারের সঙ্গে গ্রামীণ ব্যাংকের কোনো সম্পর্ক নেই। গ্রামীণ ব্যাংক স্থানীয় সরকারকে কোনো ভবন ট্যাক্স দেয় না। এটিকে অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখিয়ে সরকার থেকে ভবন ট্যাক্স মওকুফ করে নেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে, ইউনিয়ন পরিষদকে ১০টি বাধ্যতামূলক ও ৩৮টি ঐচ্ছিক দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এ দায়িত্বগুলো পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে এনজিওদের কাজ করার কোনো জায়গা থাকবে না। ছয়. এখন প্রশ্ন হলো_ ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি পদ থেকে অপসারণ করলেই কি উচ্চহারে সুদ আদায় বন্ধ হবে? সেজন্য সরকারের কাজ হবে সময়োপযোগী সমাধান খুঁজে বের করা। তবে বিলম্বে হলেও সরকার এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, ভবিষ্যতে ক্ষুদ্রঋণের পরিশোধিত টাকার ওপর কোনো সুদ দিতে হবে না। ফলে সুদের হার দাঁড়াবে ২৭ শতাংশে, আগে যা ৪০ শতাংশে পেঁৗছাতো। এ বছরের জুন থেকে সরকারের এই নির্দেশ কার্যকর হবে।

লেখকবৃন্দ : প্রফেসর ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ, ডিরেক্টর-ইন-চার্জ, জাপান স্টাডি সেন্টার, ঢা. বি., ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান, সহযোগী অধ্যাপক, বিসিএস (শিক্ষা) এবং মোশাররফ হোসেন মুসা, সদস্য, সিডিএলজি।

জে কে রাউলিং

সফল হওয়ার ইচ্ছাটা থাকা চাই
—জে কে রাউলিং | তারিখ: ০৭-০৭-২০১০
হ্যারি পটার -এর লেখক জে কে রাউলিং

ব্রিটিশ লেখক জে কে রাউলিংয়ের বিশ্বজোড়া খ্যাতি হ্যারি পটার সিরিজের জন্য। ছোটবেলা থেকেই মজার মজার গল্প লিখতেন তিনি, আর সেই গল্পগুলো লেখা শুরু করেছিলেন তাঁর বোনকে পড়ে শোনানোর জন্য। জে কে রাউলিং এখন বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় লেখক এবং ব্রিটেনের শীর্ষ ধনী নারীদের মধ্যে ১২তম। ২০০৮ সালের ৫ জুন হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির সমাবর্তন উপলক্ষে তিনি এই বক্তব্যটি দেন।

সমাবর্তন উপলক্ষে বক্তব্য দেওয়া বিশাল একটি দায়িত্ব। আমি আমার সমাবর্তনকে মনে করছি। তখন সমাবর্তন স্পিকার ছিলেন বিখ্যাত ব্রিটিশ দার্শনিক ব্যারোনেস মেরি ভারনক। তাঁর বক্তব্যের প্রতিফলন আমাকে সাহায্য করেছে এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে আমার লেখায়।
আসলে আমি আমার মন ও হূদয়কে একটি ছকে বেঁধেছিলাম এবং কী শপথ করেছিলাম, তা-ই আজ বলব। আমি আমাকেই জিজ্ঞেস করতাম, কী চাই? ২১ বছরে স্নাতক পাস করেছি, ডিগ্রি অর্জন করেছি, কিন্তু আমি কী শিখেছি আমার শিক্ষাজীবন থেকে? এখান থেকে আমি দুটো উত্তর পেয়েছি। আমাদের একাডেমিক সাফল্য উপলক্ষে যেদিন সবাই একত্র হয়েছিলাম, সেদিন আমি আলোচনা করেছিলাম, আমার সীমাবদ্ধতা ও ব্যর্থতার মধ্যে আমার লাভ কী? আমার জীবন আর তোমাদের জীবনের মাঝের যে সময়টুকু সেটাই ‘বাস্তব জীবন’। আমি চাই, আমার মতো তোমাদেরও কল্পনার শিখা যেন অনেক উজ্জ্বল হয়।
আমি ফিরে যাচ্ছি আমার ২১ বছর বয়সী জীবনে, যখন সবে গ্র্যাজুয়েশন করেছি। তখন আমি নিজেই আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করতাম। আমি চাইতাম লিখতে, উপন্যাস লিখতে। আমার মা-বাবা দুজনের কেউই কলেজে যাননি। তাঁরা খেয়াল করতেন, আমার উচ্চকল্পনাশক্তি আছে। কিন্তু তাঁরা আশা করতেন, আমি যেন একটি কারিগরি ডিগ্রি অর্জন করি। আর আমি চেয়েছিলাম ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়তে। আমি তখন একটি সমঝোতায় পৌঁছেছিলাম যে কেউই তার অবস্থানে খুশি নয়। তারপর আমি আধুনিক ভাষা নিয়ে পড়া শুরু করলাম।
আমি মনে করতে পারি না যে আমার মা-বাবা কখনো বলেছেন, আমি ভালো পড়াশোনা করি। আমি যেদিন গ্র্যাজুয়েশন পূর্ণ করি, সেদিনই হয়তো তাঁরা প্রথম বুঝতে পেরেছিলেন, আমি পড়াশোনা করি। আমি আমার মা-বাবার দৃষ্টিকোণকে দোষ দিই না। যদি তোমার হাতে স্টিয়ারিং থাকে এবং তুমি ভুল পথে যাও, তখন তোমার মা-বাবাকে দোষ দেওয়ার কিছু নেই। কারণ স্টিয়ারিং তো তোমার হাতেই ছিল। আমার মা-বাবা গরিব ছিলেন, ফলে আমিও। তাঁদের সঙ্গে আমি একমত, দারিদ্র্য খারাপ কোনো অভিজ্ঞতা নয়। দরিদ্রতার মধ্যে আছে ভয়-ভীতি, কষ্ট আর হতাশা। এই দরিদ্রতাকে জয় করতে হয় নিজের ইচ্ছাশক্তি দিয়ে। এটা যখন প্রয়োজন ঠিক তখনই হতে হবে। মনে রাখা উচিত, বোকাদের কাছে দরিদ্রতা রোমাঞ্চকর হতে পারে, তোমার কাছে নয়।
আমি তোমাদের বয়সে ইউনিভার্সিটি থেকে অনেক দূরে একটা কফিশপে বসতাম আমার গল্প লেখার জন্য। ক্লাসেও মনোযোগ দিতাম লেকচারের প্রতি। পরীক্ষায় পাস করার পর প্রতিবছরই আমি আমার সাফল্যের কথা হিসাব করতাম।
আমি জানি, তোমরা এখন প্রাপ্তবয়স্ক, এখন উচ্চশিক্ষিত। তো সেই তোমরা কঠোর পরিশ্রম করতে পারবে না, তা আমি মানি না। বুদ্ধিমত্তা কখনোই ভাগ্যের কারণে ব্যর্থ হতে পারে না এবং আমি এক মুহূর্তের জন্যও তা মনে করিনি। তোমরা হার্ভার্ড থেকে গ্র্যাজুয়েশন করেছ, তোমরা ব্যর্থতার সঙ্গে ততটা পরিচিত নও। সফল হওয়ার ইচ্ছার সঙ্গে ব্যর্থতা সম্পর্কেও তোমাদের একটু হলেও ধারণা থাকা ভালো। প্রকৃত পক্ষে, ব্যর্থতা সম্পর্কে তোমাদের ধারণা আর একজন মানুষের সফলতা সম্পর্কে ধারণা খুব বেশি দূরের নয়।
একসময় আমার জীবনটা অন্ধকারে ছিল। আমার কোনো ধারণা ছিল না, কী হচ্ছে বা কী হতে যাচ্ছে। আমার ধারণা ছিল না, এই অন্ধকারের খালটি কত বিস্তৃত হবে। তবে কেন জানি মনে হতো, একটি দিক থেকে হয়তো আলো আসবে।
আমি নিজের ওপর বিশ্বাসের জোরটাকে বাড়িয়ে দিয়েছিলাম। আমি আমাকে বোঝাতে চাইতাম, আমি কী। তার পর থেকে আমি সরাসরি আমার শক্তি বা সামর্থ্যকে ব্যবহার করেছি কোনো কাজের ভালো একটা ইতি টানতে। আমি বিশ্বাস করতাম, আমি যেকোনোভাবেই সফল হব। আমার সাফল্য কখনোই কোনো নির্দিষ্ট একটা পথ বেয়ে আসেনি। আমি বিশ্বাস করতাম, আমি সত্যিকার অর্থেই আমার সঙ্গে আছি। আমি নিজেকে মুক্ত করেছিলাম। কারণ আমার ছিল নিজেকে চেনার বিশাল এক ক্ষমতা। আমি বিশ্বাস করতাম আমাকে। আমি আমার নিম্নবিত্ত মা-বাবার মেয়ে ছিলাম। আমার একটি পুরোনো টাইপ রাইটার ছিল এবং এর সঙ্গে ছিল বড় একটা স্বপ্ন। এ বাস্তবতাই আমাকে নতুন করে, সক্ষম করে গড়ে তুলেছে।
আর আমার ছিল কল্পনা করার ক্ষমতা। এটার একটা অংশই আমাকে পুনরায় গড়তে সহায়তা করেছে, কিন্তু পুরোটা নয়। আমি শিখেছি, বিশাল এক অনুভূতির মধ্যে কল্পনার বা কল্পনাশক্তির কী মূল্য। কল্পনাশক্তিই আবিষ্কার আর অনাবিষ্কারের মধ্যে পার্থক্য গড়ে দেয়। কল্পনাশক্তি যদি প্রবল হয়, তবে সফল হওয়াটা সময়ের ব্যাপার মাত্র। এই কল্পনাশক্তিকে কাজে লাগাতে হবে, করতে হবে এর যথাযথ ব্যবহার। সবাই পারে না। যারা পারে তারাই সফল। সুতরাং তুমি নিজেই ঠিক করো, তুমি কোন দলে থাকবে।
আমার সফলতম অভিজ্ঞতা হলো হ্যারি পটার। আমি একনাগাড়ে, পর্যায়ক্রমে লিখে গেছি বলেই এটা সম্ভব হয়েছে। আর এই বিশাল কর্মযজ্ঞটি শুরু হয়েছিল আমার চাকরির শুরুর দিকে। আমি তখন চাকরি করতাম লন্ডনের অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সদর দপ্তরে আফ্রিকান গবেষণা বিভাগে। অফিসে প্রতিদিন অসংখ্য চিঠি আসত, যেখানে থাকত কী ঘটছে সেখানে, আর ঘটনাগুলো যেন সারা বিশ্ব জানতে পারে। আমি তাদের ভয়ানক ছবি দেখেছিলাম। আমি সেসব মানুষের অত্যাচারের ছবি দেখেছি।
প্রায় প্রতিদিনই আমি মানুষের ওপর মানুষের নির্যাতনের ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছি। মানুষ হয়ে তারই স্বজাতি মানুষের ওপর আঘাত করতে কুণ্ঠিত হয় না। এবং এখন পর্যন্ত অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল থেকে অনেক কিছু শিখছি, যা এর আগে কখনো শুনিনি, শিখিনি।
যা-ই হোক, আমার সর্বশেষ আশার কথাটি বলছি। আমি যখন ২১ বছরে ছিলাম, তখনকারই কথা। যাদের সঙ্গে আমি গ্র্যাজুয়েশনের দিন একসঙ্গে বসেছিলাম, তাদের অনেকেই আজ তাদের নিজ গুণে মানবসেবা এবং মানুষের জন্য কাজ করছে। অনেকেই শিশুদের নিয়ে কাজ করছে। তারা অনেক বাধার সম্মুখীন হয়েছে। মানুষের জন্য মৃত্যুভয়কেও হটিয়ে দিয়েছে। আমাদের গ্র্যাজুয়েশনে আমরা প্রচুর আশার মধ্যে আবদ্ধ ছিলাম, যা আমাদের অভিজ্ঞতা বিনিময়ের মাধ্যমে হয়েছিল। এ রকম কখনোই আর আসবে না।
সুতরাং আজকের দিনে তোমাদের মধ্যে সে রকম বন্ধুত্ব ছাড়া বেশি কিছু থাকার কথা নয় এবং আগামীকাল আমি আশা করি, যদি তুমি আমার একটি শব্দও মনে রাখো, তবে একটু হলেও সাহস পাবে সামনে চলার। যদি এটা গল্পের মতো হয়, তবে এটাই জীবন। সেটা কত দীর্ঘ, তা নয়, কত ভালো এটাই হচ্ছে বিষয়।
(ইন্টারনেট থেকে নেওয়া, সংক্ষেপিত ভাষান্তর: মোহাম্মাদ আলী)

চেতন ভগত

‘তোমরা কি জানো স্বপ্নের শুরুটা কোথায়?’

—চেতন ভগত | তারিখ: ২৩-০৬-২০১০

চেতন ভগত সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের অন্যতম জনপ্রিয় লেখক। টাইম সাময়িকী বিশ্বের প্রভাবশালী ১০০ মানুষের যে তালিকা প্রকাশ করেছে, সেখানে ঠাঁই করে নিয়েছেন ৩৬ বছর বয়সী এই লেখক। জন্ম ভারতের নয়াদিল্লিতে, ১৯৭৪ সালের ২২ এপ্রিল। তাঁর সম্পর্কে বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ এ আর রহমান বলেছেন, ‘অনেক লেখকই আছেন, যাঁরা তাঁদের হূদয়কে প্রকাশ করতে পেরেছেন লেখায়, অনেক লেখক নির্দিষ্ট ধাঁচে আপন ধ্যান-ধারণাকে প্রকাশ করতে পেরেছেন। চেতন ভগত হলেন এমনই এক লেখক, যাঁর বই একসঙ্গে দুটো কাজই করেছে, এমনকি তার চেয়ে বেশি কিছু করেছে।’ বই লেখার পাশাপাশি তরুণসমাজকে জাগিয়ে তোলার জন্য উৎসাহমূলক বক্তৃতাও করছেন চেতন ভগত। চেতন ভগত ২০০৮ সালের ২৪ জুলাই পুনের সিমবায়োসিস ইনস্টিটিউট অব বিজনেস ম্যানেজমেন্টের এমবিএ শিক্ষার্থীদের নবীনবরণ অনুষ্ঠানে যে বক্তৃতা দেন, তারই ভাষান্তর এই লেখাটি।

আমার যমজ ছেলে দুটোর লাখো ইচ্ছা, কোটি কোটি স্বপ্ন। ছোট একটা খেলনা স্পাইডারম্যানও তাদের বিছানায় লাফ-ঝাঁপ করাতে পারে। পার্কের দোলনার ক্যাচকেচে শব্দও তাদের শিহরিত করতে পারে। বাবার মুখ থেকে শোনা নিছক একটা গল্পও পারে তাদের অনুপ্রাণিত করতে। জন্মদিনের কেক কাটার জন্য কয়েক মাস আগে থেকেই তারা কাউন্টডাউন শুরু করে। তোমরা কি জানো, স্বপ্নের শুরুটা কোথায়? জানো কি, ইচ্ছাশক্তিরা কোথা থেকে আসে? আমি মনে করি, স্বপ্ন আর ইচ্ছাশক্তির জন্ম আমাদের জন্মের সঙ্গেই হয়।

সবার জীবনের একই স্বপ্ন, সফল হওয়া। আর সফলতা হলো প্রদীপের শিখার মতো। প্রদীপ জ্বালাতে তুমি কী করো? প্রথমত, প্রদীপে তেল দাও, যেন জ্বলার জন্য যথেষ্ট জ্বালানি সে পায়। পাশাপাশি কিছু একটা দিয়ে প্রদীপটা আড়ালে রাখো, যেন তা ঝড়-বাতাসের আঘাতে দপ করে নিভে না যায়। সফল হওয়ার স্বপ্নটাও ঠিক সে রকমই। প্রথমত চাই প্রবল ইচ্ছাশক্তি, যার ওপর ভর করে তুমি সফলতার দিকে এগোবে। দ্বিতীয়ত, স্বপ্নটাকে আগলে রাখা চাই। স্বপ্নকে আঁকড়ে ধরে রাখতে হয়, যেন তা কোনোভাবেই ভেঙে না যায়।

বেশির ভাগই আমরা মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। অর্থনৈতিক সচ্ছলতা তাই আমাদের কাছে বিরাট একটা অর্জন মনে হয়, আসলেও তাই। প্রতিদিনের চাওয়াগুলো যেখানে শুধু অর্থের কারণে ভেস্তে যায়, সেখানে অর্থনৈতিক মুক্তিই সবচেয়ে বড় সাফল্য। তবু এটাই জীবনের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত নয়। তাই যদি হতো, মিস্টার আমবানি (মুকেশ আমবানি, ২০০৬ সালে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তির তালিকায় ৫৬তম) আর কোনো কাজ করতেন না। শাহরুখ খান আর নাচ-গান না করে বাড়িতেই বসে থাকতেন। পিক্সার (Pixar) বিক্রি করেই যেখানে কোটি কোটি টাকা কুড়িয়েছেন, উন্নত আইফোনের জন্য স্টিভ জব নিশ্চয়ই আর কঠোর পরিশ্রম করতেন না। তাঁরা এসব এখনো করছেন কেন? কী এমন জিনিস, যা তাঁদের টেনে আনে প্রতিদিনের কাজে, ভেবে দেখেছ কি? তাঁরা এটা করেন কারণ, এতে তাঁরা সুখ খুঁজে পান, আনন্দ পান। তাঁরা এটা করেন কারণ, কাজের মধ্যেই নিজেকে বাঁচিয়ে রাখেন তাঁরা। কাজের মধ্যেই তাঁরা জীবনকে উপভোগ করেন। তুমি যদি পরিশ্রমী হও, বেশি বেশি পড়াশোনা করো, তুমিও তোমার ফলাফলের মান বাড়াতে পারবে। যদি মানুষের সঙ্গে মিথোস্ক্রিয়া বা স্বতঃস্ফূর্ত মিতালি গড়ে তোলার চেষ্টা করো, দেখবে তুমি যেকোনো সাক্ষাৎকারে ভালো করছ। বেশি বেশি অনুশীলন করলে ক্রিকেটেও তুমি ভালো করতে পারো। এটা হয়তো ঠিক যে তুমি কখনোই টেন্ডুলকার হতে পারবে না। কিন্তু আগের চেয়ে আরেক ধাপ এগোতে তো পারবে। হ্যাঁ, সফল হওয়ার জন্য পরিশ্রম, অনুশীলন আর সংগ্রামের মাধ্যমে এক ধাপ করে এগোনোটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

নিশ্চয়ই কারও মুখে শুনে থাকবে, জীবন একটা কঠিন ও লম্বা দৌড়। আর আমি যেভাবে দেখেছি, জীবনটা হলো সেই দৌড়ের মতো, যেটা আমরা নার্সারি স্কুলে দৌড়েছি। মুখের মধ্যে একটা চামচ, চামচের ওপর একটা মার্বেল নিয়ে দিতে হবে দৌড়। মার্বেল ফেলে খালি চামচ নিয়ে সবার আগে দৌড়ের শেষ দড়িটা ছোঁয়ার কি কোনো মানে আছে? জীবনটাও ঠিক তাই। যেখানে নিজের স্বাস্থ্য আর মানুষের সঙ্গে তোমার সম্পর্ক হলো মার্বেল। তোমার পরিশ্রম তখনই সার্থক হবে, যখন জীবনে ছন্দ আসবে। নইলে তুমি হয়তো সফল হবে, কিন্তু এই যে স্বপ্ন সজিব থাকার, আলোকিত হওয়ার, ধীরে ধীরে সেই স্বপ্ন শুকিয়ে মারা যাবে।

জীবনকে কখনোই সিরিয়াসভাবে দেখবে না। যোগব্যায়ামের ক্লাসে একজন শিক্ষক শিক্ষার্থীদের হাসানোর জন্য নানা গল্প করতেন। একদিন এক ছাত্র জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা স্যার, যোগব্যায়ামের ক্লাস থেকে হাসাহাসির গল্প বাদ দিলে কী হবে?’ স্যার বললেন, ‘সিরিয়াস নয়, সিনসিয়ার হও।’ স্যারের সেদিনের এই কথাটা আমার প্রেরণা জুগিয়েছে—কি লেখায়, কি কাজে কিংবা সবার সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে। দেখ, লেখালেখিতে প্রতিদিনই আমার নতুন নতুন ছক-মতের সৃষ্টি হয়। প্রতিদিন প্রশংসা পাই আবার শুনতে হয় কঠোর সমালোচনাও। আমি যদি সবকিছুকেই গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নিই, তাহলে কীভাবে আমি লিখব? কিংবা আমি বাঁচব কীভাবে? জীবনটাকে খুব কঠিনভাবে নেওয়ার কিছু নেই। এই তিনটা জিনিস মনে রেখ—লক্ষ্যটা হতে হবে যৌক্তিক, স্বপ্নের সঙ্গে কাজের থাকবে ভারসাম্য আর কাজ করবে আনন্দের সঙ্গে। হ্যাঁ, কাজের ফাঁকে ফাঁকে প্রাণে থাকা চাই আনন্দ। কটা ক্লাস ফাঁকি দেবে, ইন্টারভিউতে তালগোল পাকিয়ে ফেলবে, প্রেমে পড়বে—এসব হতেই পারে। আমরা তো আর মেশিন নই।

প্রথমত, স্বপ্ন ভাঙে যে ঝড়ে, তার নাম ব্যর্থতা। যদি সবকিছু পরিকল্পনা অনুসারে না হয়, তখন তুমি নিজেকে ব্যর্থ মনে করো। পরিশ্রমের তুলনায় ফল না পেলে তুমি বিচলিত হয়ে যাও। ঠিক আছে। কিন্তু বড় হতে হলে নিজেকে আরও শক্ত করতে হবে। ব্যর্থতা এড়ানো খুবই কঠিন। তবে ‘ব্যর্থতা আমাকে কী শেখাল’ নিজেকে এই প্রশ্ন করতে হবে। নিজের ভুলগুলো শুধরে নিতে হবে। হয়তো নিজেকে তুমি দুর্বল ভাবো। হীনম্মন্যতায় ভোগো। সবকিছুর আশা ছেড়ে পালিয়ে বাঁচতে ইচ্ছে করবে তোমার। যেমনটা আমার হয়েছিল, যখন নয় জন প্রকাশক আমার প্রথম বইটা প্রকাশ করার ব্যাপারে ‘না’ বলেছিলেন। জীবনটা আসলে তা-ই, প্রতিযোগিতায় ভরা। হীনম্মন্যতায় না ভুগে বারবার চেষ্টা-সাধনায় যেকোনো সমস্যার সমাধান করতে হবে।

হতাশা হলো ব্যর্থতার মামাতো ভাই। তুমি কি কখনো হতাশ হয়েছ? তা আবার বলতে, কী বলো? যানজট থেকে শুরু করে কাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে হতাশা ঘিরে ধরে আমাদের। হতাশা তোমার উত্তেজনার স্ফুলিঙ্গকে স্তিমিত করে দেয়। এবং সহসা নেতিবাচক ভাবনার সাগরে ডুবিয়ে অকাল মৃত্যু ডেকে আনে তোমার ভেতরের সুপ্ত ইচ্ছাটার। হতাশা তোমাকে তিলে তিলে তিক্ত করে দেয়। এ জন্য বড় হতে চাইলে হতাশাকে অবজ্ঞা-উপেক্ষা করতে শিখতে হবে।

আজকাল তো সবকিছু লাইন-ঘাটের ব্যাপার। যার বাবা ধনী, যার মুখ সুন্দর, তারা বলিউড থেকে শুরু করে যেকোনো জায়গায় সহজেই সুযোগ পাচ্ছে। গোটা দেশটা যেন বৈষম্যে ছেয়ে গেছে। তবু যা কিছু আছে, তা-ই নিয়ে সন্তুষ্ট থাকা উচিত। একই সঙ্গে যা নেই, তাকে গ্রহণ করার মানসিকতাও থাকতে হবে। দেখ, আমি কিন্তু ঐশ্বরিয়া রাইকে অপছন্দ করি না। কিন্তু আমার দুটো ছেলে আছে, আমি মনে করি তারা ঐশ্বরিয়ার চেয়ে অনেক সুন্দর। হাল ছেড়ো না। কখনোই বৈষম্য-বিচিন্তায় নিজের স্বপ্নকে ছোট করে দেখবে না।

তুমি যতই বড় হবে, নিজেকে আলাদা করে আবিষ্কার করবে। তুমি যখন ছোট ছিলে, আর সব বাচ্চার মতো তুমিও কিন্তু আইসক্রিম খেতে ভালোবাসতে। এখন তুমি কলেজে পড়ছ। কলেজে তোমার মতো আরও অনেক ছাত্র আছে। কিন্তু ১০ বছর পরে নিজেকে সম্পূর্ণ একা দেখবে। তুমি যা চাও, যা তুমি বিশ্বাস করো, যেভাবে ভাবতে ভালোবাস, হয়তো কিছুই তার মিলবে না একেবারে পাশের মানুষটির সঙ্গে। কারও সঙ্গে তোমার স্বপ্নের মিল না দেখে তোমার মনের ভেতর এক ধরনের দ্বন্দ্ব তৈরি হতে পারে। কিন্তু কখনোই স্বপ্নের সঙ্গে আপস করবে না। নিজেকেও ভালোবাসতে জানতে হয়। আগে নিজেকে ভালোবাস, তার পরে ভালোবাস অন্যকে।

তোমরা এখন জীবনের সবচেয়ে আনন্দের বয়সে আছ। কেউ যদি আমাকে অতীতে ফিরে যাওয়ার সুযোগ দিত, নিশ্চয়ই আমি বেছে নিতাম কলেজজীবনকে। এই সময়ে সবার চোখ-মুখে থাকে জ্যোতি। শোনো, বর্ষাকালে বৃষ্টি হবে এটাই স্বাভাবিক। তোমার জীবনেও স্বপ্নপূরণের পথে এ রকম বাধাবিপত্তি একের পর এক আসতেই পারে। বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য যেমন ছাতা কিংবা বৃষ্টির পোশাক ব্যবহার করো, ঠিক তেমনি স্বপ্নকেও তোমার সেভাবেই আগলে রাখতে হবে। তুমি, আমি সব মানুষই স্বপ্ন দেখি। সবার মধ্যেই আছে আলোর দ্যুতি। এ জন্যই আমি বলে থাকি, আমি এসেছি লাখো-কোটি নক্ষত্রের আলোয় আলোকিত দেশ থেকে।

টিম বারনার্স লি

ওয়েবের উদ্ভাবক টিম বারনার্স লি

ডব্লিউ ডব্লিউ ডব্লিউ

জাহাঙ্গীর আলম | তারিখ: ০৯-০৬-২০১০

ডব্লিউ ডব্লিউ ডব্লিউ—ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব (www)। বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ এটা ব্যবহার করছে। কিন্তু কে আবিষ্কার করেছেন এই ওয়েব? আমাদের ক্ষুদ্র একটা অংশ তাঁর নাম শুনেছে। বিশ্বের অনেক মানুষের কাছে অপরিচিত একটা মুখ। যদিও তাঁর উদ্ভাবন আজ সারা বিশ্বের সব মানুষকে গভীরভাবে প্রভাবিত করছে। তিনি হলেন টিম বারনার্স লি। তাঁকে বলা হয় ওয়েবের প্রতিষ্ঠাতা। ৮ জুন ছিল তাঁর ৫৫তম জন্মদিন। জন্মদিনে তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে এই রচনা।

ফেলে আসা কৌতূহলী শৈশব তাঁর

যদি সত্যিই আমাদের ‘টাইম মেশিন’ থাকত তাহলে ইচ্ছে হলেই চলে যেতে পারতাম ১৯৬০-এর দশকের লন্ডনের একটি বাড়িতে। আর সেখানে দেখতে পেতাম এক যুবককে। মা মেরি উডস লি যে ঘরে রান্না করেন, সে ঘরে যুবকটি বাবা কনওয়ে বারনার্স লির পাশে বসে খেলার সামগ্রী দিয়ে বানানোর চেষ্টা করছে তার নিজের কম্পিউটার। ওই যুবকটিই টিম বারনার্স লি। লি তাঁর চারপাশের জগৎ নিয়ে শৈশব থেকেই খুবই কৌতূহলী। তো একদিন ঘরের কোণে তিনি দেখতে পেলেন নোংরা পুরোনা ও ভিক্টোরিয়ান যুগের এনসাইক্লোপিডিয়া নামের এক গ্রন্থ। গ্রন্থটি সম্পর্কে লি বলেন, ‘ওই বইয়ের রহস্যময় এক শিরোনাম “সবকিছুর ভিতরে ও বাহিরে অনুসন্ধান” আমার কৌতূহল আরও কয়েক গুণ বাড়িয়ে তোলে।’

টিম লির ফেলে আসা সেই সব শৈশবে ঘুরতে গেলে আপনি দেখতে পাবেন, টিম মূলত দুটি বিষয়ের প্রতি খুবই আগ্রহী এবং অনুসন্ধানপ্রিয় বালক এক। এক. কম্পিউটার। দুই. একটি ভাবনা: ‘কী করে মন বা মস্তিষ্ক অনেক ঘটনার মধ্য থেকে কিছু ঘটনাকে সময়ের প্রয়োজনে খুব দ্রুত পাশাপাশি আনে? কী করে গান কিংবা গন্ধ মানুষের মনে জড়িয়ে যায়? এসব নিয়ে ভাবতে ভালোবাসতাম।’ বলেন অনুসন্ধানী টিম লি।

মানুষে মানুষে বিশ্ববন্ধন গড়ার স্বপ্ন যখন

পড়াশোনায় লি অসাধারণ মেধাবী ছিলেন। ১৯৭৬ সালে পদার্থবিজ্ঞানে প্রথম শ্রেণীতে ডিগ্রি পান। এর চার বছর পর উদীয়মান তরুণটির বয়স তখন ছুঁই ছুঁই পঁচিশ। তিনি পাড়ি জমালেন সুইজারল্যান্ডে। উদ্দেশ্য জেনেভায় সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে যোগদান। সেখানে প্রয়োজন পড়লেই বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নানা কর্মী তাঁকে প্রশ্ন করত। অনেক সময় প্রশ্নগুলো ছিল একই। ফলে বারবার একই ধরনের উত্তর দিতে হতো। লি তখন চিন্তায় পড়ে গেলেন, ‘কী করে আমার ক্ষুদ্র মাথা সব প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত-প্রতিবেদন ইত্যাদি সর্বদা স্মরণে রাখবে?’ তিনি ভাবলেন, আচ্ছা যদি এমন কোনো পথ থাকত যে কম্পিউটারের মাধ্যমে কর্মীরা তাঁর কাছ থেকে খুব সহজেই সব প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করবে, যাতে কর্মীরা কে কোথায় কত দূরে আছে সেটা কোনো বাধা হবে না? মানুষে মানুষে বিশ্ববন্ধন গড়ার এক মহাজাগতিক স্বপ্নের শুরু এখানেই, টিম বারনার্স লির হাতে।

ইনকুয়ার: একটি স্বপ্নের সত্যায়ন

এরপর টিম এমন একটা সফটওয়ার প্রোগ্রাম তৈরি করলেন, যেটা গুরুত্বপূর্ণ সব তথ্যকে সামলাবে। এর জন্য তিনি অনেকগুলো লিংক ব্যবহার করলেন। এবং তিনি এগুলোকে একটা বইয়ে থাকা সূচিপত্রের মতো করে সাজালেন। প্রোগ্রামটির নাম রাখলেন ইনকুয়ার বা অনুসন্ধান। টিম লি এটিকে স্মৃতিশক্তির প্রতিনিধি বলে অ্যাখ্যা দেন। ইনকুয়ার নামটি সেই এনসাইক্লোপিডিয়া বই থেকে নেওয়া, যে বইটি তিনি শৈশবে পেয়েছিলেন তাঁর ঘরের কোণে। এরপর উত্তরোত্তর উন্নতিসাধনের মধ্য দিয়ে ১৯৯১ সালে যাত্রা শুরু হলো ওয়েবের। বিশ্বের প্রথম ওয়েবসাইটটির নাম ছিল ইনফো.সার্ন.সিএইচ (info.cern.ch)। এবং প্রথম ওয়েবপেজের ঠিকানা ছিল: http://info.cern.ch/hypertext/WWW/TheProject.html।

হতাশা যাঁকে ছুঁতে পারেনি

আপনার কি স্মরণে আছে, বৈদ্যুতিক বাতি আবিষ্কারের পর টমাস আলভা এডিসন হতাশা ও ব্যর্থতা সম্পর্কে কী বলেছিলেন? ‘আপনি নাকি ১০ হাজার বার ব্যর্থ হয়েছেন বাতি জ্বালানোর আগে?’ এর জবাবে এডিসন বলেছিলেন, ‘ব্যর্থতা বলে কোনো কথা নেই। বৈদ্যুতিক বাতি সফলভাবে জ্বালানোর আগ পর্যন্ত ওই সব একেকটি চেষ্টা ছিল একেকটি পথ। হতাশা আমাকে গ্রাস করেনি।’ না, হতাশা কখনোই অধ্যবসায়ী আর পরিশ্রমী মানুষকে গ্রাস করতে পারে না। তেমনি টিম লিকেও থমকে দিতে পারেনি হতাশা। অনেকে মনে করেছিল, কোনোভাবেই টিমের এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হবে না। আর যদি হয়ও, তাহলে এটা জনপ্রিয়তা পাবে না। খুব কমসংখ্যক বন্ধু তাঁর স্বপ্নকে সমর্থন করত। তবু বন্ধুদের তুমুল সমালোচনায়ও হাল ছাড়েননি টিম লি। স্বপ্নের প্রতি ছল তাঁর অগাধ শ্রদ্ধা। স্বপ্নের সমান শ্রম ছিল তাঁর আদর্শ। এবং নিরলস সাধনায় তিনি তাঁর স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে সক্ষম হয়েছেন।

সাদামাটা জীবন তাঁর

ইতিমধ্যে বয়সের ঘর থেকে ৫৫টি বছর মুছে মিশে গেছে তাঁর ফেলে আসা অতীতে। কিন্তু ভবিষ্যতের আবিষ্কারককে বর্তমানে দেখলে তরুণই লাগে। মানুষটিকে দেখলেই বোঝা যাবে, বিলাসপ্রিয় মানুষ নন তিনি। ‘বর্ষসেরা তরুণ নেতা’, ‘নাইট কমান্ডার’, ‘মহা ব্রিটন’ নানা উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন। ১৯৯৯ সালে টাইম ম্যাগাজিন বিশ শতকের শ্রেষ্ঠ ১০০ ব্যক্তির নামের একটি তালিকা প্রকাশ করে। ওই তালিকায় টিম লির নাম ছিল। ২০০৭ সালে দ্য টেলিগ্রাফ জীবিত ১০০ বুদ্ধিজীবী মহামনীষীর একটি তালিকা তৈরি করে। আলবার্ট হফম্যানের সঙ্গে যুগ্মভাবে তিনি সে তালিকায় প্রথম হয়েছিলেন। কিন্তু সাদাসিধে পোশাক আর সাদামাটা জীবনই ভালো লাগে তাঁর। ‘কী অর্জন করেছি সেটা আমার কাছে মুখ্য বিষয় নয়, আমি কত কিছু না-করা থেকে নিজেকে স্বেচ্ছায় এড়িয়ে রেখেছি সেটাই খুব গুরুত্বপূর্ণ।’ তাঁর এই কথা থেকেই উঠে আসে তিনি কতটা স্বচ্ছ আর শান্ত জীবন যাপনে অভ্যস্ত।

ভালো-মন্দের মানদণ্ড মূল্যবোধ

ওয়েবের ভালো দিকের পাশাপাশি মন্দ দিকও হয়তো আছে। এবং সেটা ব্যবহারকারীর ওপর নির্ভর করে। নিউক্লিয়ার শক্তির অপপ্রয়োগের জন্য যেমন আলবার্ট আইনস্টাইনকে দায়ী করা যাবে না, ঠিক তেমনি ওয়েবের অপব্যবহারের জন্যও টিম লি দায়ী হবেন না। এ বিষয়ে টিম লি বলেন, ‘সময়ের বিবর্তনে এটা স্পষ্ট হবে। প্রযুক্তির ভালো-খারাপ দুই দিকই আছে। ওয়েবের ভালো-মন্দ নির্ভর করে আমাদেরই ওপর। মূলত আমরা কীভাবে এটা ব্যবহার করি, কীভাবে আমরা শিশুদের শেখাচ্ছি বা আমাদের মূল্যবোধ কেমন তার ওপরই নির্ভর করে ওয়েব ভালো না মন্দ।’

যে পথে কেউ হাঁটেনি

অনেক পথই তো ছিল যে পথে হাঁটতে পারতেন টিম লি। এখন তিনি সচ্ছল মানের একটা নির্ধারিত পারিশ্রমিকে জীবন যাপন করছেন। কিন্তু ওয়েব আবিষ্কারের দরুন বিশেষ কোনো সুযোগ গ্রহণ করছেন না। কেন? যে পথে সবাই হাঁটে সে পথে হাঁটতে চাননি টিম লি।

আর কী চাই তাঁর?

টিম লি বিয়ে করেছেন ন্যান্সি কার্লসনকে। তাঁদের এখন দুই সন্তান। নিজেকে কখন সবচেয়ে সুখী বলে মনে হয় টিম লির? তিনি বলেন, ‘আমি যখন আমাকে হারিয়ে গবেষণায় আত্মনিয়োগ করি তখনই নিজেকে সবচেয়ে সুখী মনে হয়।’ এখন তাঁর অধিকাংশ সময় কাটে ওয়েবের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তাভাবনায়। তার চেয়ে বড় ভাবনা তাঁর ওয়েবের স্বাধীনতা নিয়ে। টিম লি চান না, কোনো প্রতিষ্ঠান বা কেউ কখনো এই ওয়েবের মালিকানা হাতে নিয়ে বিশ্বের মানুষকে একই বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া থেকে বঞ্চিত করুক। এ জন্যই তিনি এখনো ওয়েবের জন্য কোনো প্যাটেন্ট নেওয়ার পরিকল্পনা করেননি! বর্তমানের বাণিজ্যিক বিশ্বে বিরল এর্টি ঘটনা এটি। টি লি বলেন, ‘আমি চাই সব মানুষ এক হোক।’

এ পি জে আবদুল কালাম

স্বপ্নপূরণের পথে

এ পি জে আবদুল কালাম | তারিখ: ১২-০৫-২০১০

পুরো নাম আবুল পাকির জয়নুলাবেদীন আবদুল কালাম। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এবং বিজ্ঞানী। ১৯৩১ সালের ১৫ অক্টোবর ভারতের তামিলনাড়ুতে তাঁর জন্ম। জীবনে বহুবার নানা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তরুণদের উদ্দেশে প্রেরণাদায়ক ও উত্সাহব্যঞ্জক বক্তৃতা করেছেন এই ‘ভারতরত্ন’। সর্বশেষ ১৯ এপ্রিল, ২০১০ জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ে তরুণদের উদ্দেশে ‘জীবন, স্বপ্ন ও কাজ’-এর ওপর যে বক্তৃতা করেন এখানে তার নির্বাচিত অংশ।

জীবনের লক্ষ্য: স্বপ্ন আর দৃঢ় সংকল্প

বন্ধুরা, সফল যাঁরা, কেমন তাঁরা—এ প্রশ্ন অনেকেরই। তুমি যদি কোনো সফল ও আদর্শ মানুষের জীবনের ইতিহাস চর্চা করো, দেখবে, শৈশবেই তাঁর মনে একটা স্বপ্ন বাসা বাঁধে। স্বপ্নটাকে সত্যি করার জন্য একটা দৃঢ় সংকল্প থাকে তাঁর। আর প্রতি পদে-পরিস্থিতিতে স্বপ্নটা তাঁকে স্মরণ করিয়ে দেয় লক্ষ্য ছোঁয়ার কথা। আর কারও নয়, নিজের সত্যি গল্পটাই তোমাদের শোনাতে পারি।

বয়স তখন সবে ১০। তখনো কিন্তু আমরা বিদ্যুত্ পাইনি। মনে আছে, সন্ধ্যা নামলে কেরোসিনের প্রদীপ জ্বালিয়ে পড়তাম। সেই কেরোসিন ছিল রেশন কার্ড দিয়ে কেনা! আমি তখন পড়ি পঞ্চম শ্রেণীতে। শ্রী শিবাসুব্রাহ্মনিয়া ছিল আমাদের সবার পছন্দের শিক্ষক। একদিন তিনি ব্ল্যাকবোর্ডে উড়ন্ত একটা পাখির চিত্র আঁকলেন। পাখিরা কীভাবে ওড়ে, উড়তে উড়তে কী করে তারা পথ পাল্টায়, তিনি তা শেখাচ্ছিলেন। ২৫ মিনিটের ক্লাস। এরপর তিনি জানতে চাইলেন, ‘বুঝতে পেরেছ?’ আমি দ্বিধাহীনভাবে বললাম, ‘না’। ক্লাসের অনেক ছাত্রই বলল, ‘বুঝতে পারিনি’। স্যার কিন্তু রাগলেন না। বরং বিকেলে আমাদের নিয়ে গেলেন রামেশ্বরাম সমুদ্রসৈকতে। জলের কলতান আর পাখিদের কিচিরমিচির গান, ওহ! এখনো ভুলতে পারিনি সেই সন্ধ্যার স্মৃতিটা। লেজ বাঁকিয়ে ডানা ঝাপটে পতপত শব্দে কী সুন্দর উড়ছে পাখিরা। কী আশ্চর্য, যেদিকে মন চাই সেদিকেই উড়ছে তারা। ‘বলো তো বন্ধুরা,’ স্যার জানতে চাইলেন, ‘ওড়ার জন্য পাখিদের ইঞ্জিনটা কোথায়?’ কিছুক্ষণ পরে আঁধার নেমে এল, কিন্তু আমরা এরই মধ্যে জেনে গেছি, পাখিরা ওড়ে নিজ জীবন আর ইচ্ছাশক্তির প্রেরণায়।

সন্ধ্যায় বাসায় ফিরলাম উড়ু উড়ু মন নিয়ে। বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে তারাদের দিকে তাকিয়ে মনে মনে ঠিক করলাম, বিমান-বিজ্ঞানী হব। পরের দিন স্যারকে গিয়ে বললাম, ‘স্যার, কীভাবে আমি বিমান-বিজ্ঞান সম্পর্কে আরও জানতে পারব?’ তিনি বললেন, ‘আগে অষ্টম শ্রেণী শেষ করো। তারপর হাই স্কুলে যাবে। এরপর যেতে হবে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে। যদি তুমি সব ক্লাসেই ভালো করো, তবেই তোমার স্বপ্ন সত্যি হবে।’ কলেজে পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে পড়ার পর আমি মাদ্রাজ ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনা করি। নিরন্তর শ্রম সাধনায় হয়ে উঠলাম একজন রকেট ইঞ্জিনিয়ার ও প্রযুক্তিবিদ। সেদিনের দেখা স্বপ্নটা আমার এভাবেই সত্যি হলো।

বন্ধুরা, তোমরা কামারশালায় গেলে দেখবে, কীভাবে আগুনে লোহা গলিয়ে নির্দিষ্ট ছাঁচের হাতুড়ি বানানো হয়। ঠিক একইভাবে তোমার জীবনের লক্ষ্যটাকে নির্দিষ্ট করতে হবে। স্বপ্ন দেখো আর দৃঢ় সংকল্প আঁকো মনের মধ্যে।

চাই জ্ঞান চর্চা

মনের কোণে শুধু স্বপ্ন আঁকলেই তো হবে না। চাই নিরবচ্ছিন্ন জ্ঞান আহরণ। তা ছাড়া স্বপ্ন কখনোই সত্যি হবে না। জ্ঞান তোমাকে মহান করবে। জ্ঞান তোমাকে সফলতার দ্বারে ঠেলে নিয়ে যাবে। কাজ করার সময় নানা সমস্যা দেখা যাবে। কিন্তু মনে রাখবে, সমস্যা যেন কোনোভাবেই তোমার ওপর গুরুগিরি করতে না পারে। সমস্যাকে পাশ কাটানোর চেষ্টা করবে না। সমস্যার সমাধান করেই এগোতে হবে তোমাকে। দেখবে সাফল্যরা কেমন সূর্যের মতো, তারাদের মতো তোমার চারপাশে ঝিলমিল করবে।

কঠোর পরিশ্রম

লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য অবশ্যই কঠিন পরিশ্রমী হতে হবে। অর্জিত জ্ঞানকে কাজে লাগাতে হবে। সময়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। আমার জীবন থেকে বুঝেছি, কেউ যখন কোনো স্বপ্ন পূরণের জন্য সচেষ্ট হয়, তার মনে এক ধরনের জেদ তৈরি হয়। ফলে তার কাজের ক্ষমতা ও দক্ষতা বাড়ে। স্বপ্ন আর কাজের মাধ্যমেই তৈরি হয় মেধা। মনে রাখবে, তুমি যতই বিশেষজ্ঞ হও না কেন, তোমাকে অবশ্যই প্রশিক্ষণের মধ্যে থাকতে হবে। কারণ, অনুশীলনের বিকল্প কিছু নেই। স্বপ্ন যদি পূরণ করতে চাও, তোমার যত শক্তি তার সবটুকু প্রয়োগ করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।

ব্যর্থতা জয় করার সাহস

তুমি যখন কোনো লক্ষ্য পূরণের জন্য কাজ করবে, দেখবে সেখানে অনেক ধরনের সমস্যা আসবে। হয়তো সমস্যার সমাধান করতে পারছ না। নিজেকে ব্যর্থ মনে হতে পারে। তোমার মনে হবে, আর বুঝি সম্ভব না। কিন্তু সত্যিকারের সফল যারা, তারা ব্যর্থতাকে ভয় করে না। বরং তারা জানে, ব্যর্থতাকে জয় করেই এগোতে হবে। ব্যর্থ হলে প্রথমেই ধৈর্য ধরতে হবে। মনে রেখো, পরিস্থিতি সামলাতে হবে নিজেকেই। এ জন্য দরকার সাহস।

নিজের সঙ্গে প্রতিযোগিতা

পৃথিবীতে কেউ শ্রেষ্ঠ হয়ে জন্মগ্রহণ করে না। এটা একটা প্রক্রিয়া, যার মধ্য দিয়ে একজন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কিংবা একটা জাতি নিজের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে। সফলদের একটা স্বপ্ন থাকে। সেই স্বপ্নের পেছনেই তারা ছোটে। আগে থেকেই তারা প্রস্তুত থাকে যেকোনো ঝুঁকি মোকাবিলা করার জন্য। ব্যর্থ হলে তারা ভেঙে পড়ে না। বরং নতুন উদ্যমে কাজ করে যায়। নিজের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে সংগ্রাম চালিয়ে যায়। তারা কারও সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে না। কিন্তু তারা নিজেদের সঙ্গেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। গতকাল যতটা কাজ করেছে আজ তার চেয়ে বেশি কাজ করে। আর প্রতিজ্ঞা করে, আজ যা কাজ করেছে তার চেয়ে বেশি কাজ করবে আগামীকাল। তুমিও তা-ই করো। এভাবেই শ্রেষ্ঠত্ব আসে। এভাবেই স্বপ্ন হয় সত্যি।

নির্বাচিত অংশ ভাষান্তর: জাহাঙ্গীর আলম

http://youcanwin24.wordpress.com/2010/12/15/%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%AC%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%A8%E0%A6%AA%E0%A7%82%E0%A6%B0%E0%A6%A3%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%AA%E0%A6%A5%E0%A7%87/

আল্লামা শেখ ড. ইউসুফ আল-কারযাভী

আল্লামা শেখ ড. ইউসুফ আল-কারযাভী

ধ্যান ॥ উচ্চস্তরের ইবাদত

সর্বজনমান্য
ইসলামি চিন্তাবিদ। ১৯৭৩ সালে আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের উসূল আদ-দ্বীন অনুষদ  হতে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ড. কারযাভী মিশর সরকারের বোর্ড অব রিলিজিয়াস এফেয়ার্স এর সদস্য, কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের শরীয়াহ ও ইসলামিক স্টাডিজ অনুষদের ডীন এবং আলজেরিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের ইসলামিক সায়েন্টিফিক কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ছিলেন। বর্তমানে
তিনি ইউরোপিয়ান কাউন্সিল ফর ফতোয়া এন্ড রিসার্চ-এর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এ পর্যন্ত তার ৫০টিরও বেশি
গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ইংরেজি তুর্কি ফারসি উর্দু ইন্দোনেশীয়সহ বিশ্বের অন্যান্য ভাষায় তার বই অনূদিত ও প্রকাশিত হয়েছে। বাংলা ভাষায় অনূদিত তার বইগুলোর মধ্যে রয়েছে ইসলামে হালাল-হারামের বিধান, ইসলামের যাকাত
বিধান, ইসলামী শরীয়তের বাস্তবায়ন, ইসলামী পুনর্জাগরণ : সমস্যা ও সম্ভাবনা এবং দারিদ্র বিমোচনে ইসলাম ইত্যাদি।
আল্লামা কারযাভী আল জাজিরা টেলিভিশনের ‘শরীয়া এন্ড লাইফ’ সাপ্তাহিক অনুষ্ঠানে সরাসরি কোরআন ও
জীবন সম্পর্কিত প্রশ্নোত্তর ও ফতোয়া প্রদান করেন। আজকের বিশ্বে মুসলমানদের প্রধান সমস্যা হচ্ছে, আধুনিক জ্ঞানের সকল শাখায়ই তারা পশ্চাত্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। যারা বর্তমান তথাকথিত ধার্মিক মানুষদের আচরণ দিয়ে ধর্মকে
বিচার করেন তারা ভ্রান্তভাবে একেই আমাদের ধর্ম বা মূল্যবোধ হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন। অথচ অতীতে ইসলামি সভ্যতা ছিলো বিশ্বের সবচেয়ে সমৃদ্ধ সভ্যতার অন্যতম। মুসলিম বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ছিলো জ্ঞানকেন্দ্র যা মুখরিত থাকতো প্রাচ্য ও
পাশ্চাত্যের শিক্ষার্থীদের পদচারণায়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর খ্যাতনামা শিক্ষকদের বই আন্তর্জাতিকভাবেই পণ্ডিতদের নিকট গণ্য হতো রেফারেন্সরূপে। আরবি ভাষা জ্ঞানচর্চায় পালন করেছে মৌলিক ভূমিকা। রবার্ট ব্রিফল্ট, জর্জ সার্টন, গুস্তব লি বন এবং উইল ডুরান্ত-এর মতো ঐতিহাসিকগণ এ ব্যাপারে প্রকাশ করেছেন ঐকমত্য।পিওর সায়েন্স ধর্ম-বর্ণ-গোত্র বা সংস্কৃতির প্রভাবমুক্ত। তবে এর নেপথ্য দর্শন বা শিক্ষা প্রক্রিয়ার বিষয়টি ভিন্ন। মানব ও সমাজবিজ্ঞান স্বাভাবিকভাবেই মানুষের সাথে সম্পৃক্ত। স্বভাবতই তা তাদের আচরণ বিশ্বাস মূল্যবোধ ও পারস্পরিক সম্পর্ক দ্বারা প্রভাবিত। যদিও কিছু কিছু বুদ্ধিজীবী দাবি করেন, মানবীয় বিজ্ঞানগুলো আন্তঃসাংস্কৃতিক, কিন্তু বাস্তবে তা মূলত পাশ্চাত্যের চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গিরই প্রকাশ।মুসলিম বিশেষজ্ঞদের অবশ্যই মুক্তমন নিয়ে এ বিজ্ঞানগুলো পর্যালোচনা করা উচিত। প্রয়োজন ইসলামের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে বিশ্লেষণ করা। এতে নতুন তথ্য ও উপাত্ত পাওয়া যাবে যা এ বিজ্ঞানগুলোয় বিরাজমান অনেক প্রশ্নের উত্তর পেতে সাহায্য করবে।সোশ্যাল সায়েন্সের একটি বিশাল ক্ষেত্র হচ্ছে মনোবিজ্ঞান, যাতে ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গি সংযোজিত হলে অফুরন্ত কল্যাণ সাধিত হতে পারে। কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে মানবাত্মা, তার সহজাত সম্ভাবনা ও দৃশ্যমান আচরণ গবেষণার অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। সামপ্রতিককালে মুসলিম বিশেষজ্ঞরা এ ক্ষেত্রে বেশকিছু কাজ করেছেন। এ ক্ষেত্রে অগ্রগামীদের একজন হচ্ছেন মিশরীয়
বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মোহাম্মদ ওসমান নাজাতী। যিনি ‘আল কোরআন ওয়া ইলম আন-নাফস’ (আল কোরআন ও মনোবিজ্ঞান) এবং ‘আল হাদীস ওয়া ইলম আন-নাফস’ (আল হাদীস ও মনোবিজ্ঞান) নামে দুটি গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। দ্বিতীয়জন অধ্যাপক মালিক বাদ্‌রী, তিনি বিশিষ্ট গবেষক, মনোবিজ্ঞানী ও থেরাপিস্ট। অধ্যাপক বাদ্‌রী প্রচলিত মনোবিজ্ঞানের সাথে ইসলামের ভঙ্গি সংযুক্ত করে নতুন এক ধারার সূত্রপাত করেছেন। তিনি ইসলামি আকিদা বিশ্বাস, মূল্যবোধ ও আমল থেকে সূত্র নিয়ে তা প্রয়োগ করে বিভিন্ন মানসিক রোগ নিরাময়ে কার্যকরী ভূমিকা রেখেছেন। রসুলুল্লাহ (স) বলেছেন, ‘আল্লাহ এমন কোনো রোগ সৃষ্টি করেন নি যার নিরাময় নেই। কেউ এই নিরাময় জানে, কেউ জানে না।’ রসুলুল্লাহ (স)-র এ বাণী শারীরিক এবং মানসিক- ভয়
রোগের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।অধ্যাপক বাদ্‌রী তার বর্তমান গ্রন্থ ‘আল-তাফাক্কুর মিন আল মুশাহাদাহ ইলা আল-শুহুদ’ (Contemplation : An Islamic Psychospiritual Study)-তে আধুনিক মনোবিজ্ঞান ও ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোকপাত করেছেন। বইয়ের আরবি নামকে ইংরেজিতে অনায়াসে বলা যায় Contemplation : from perception to spiritual cognition অর্থাৎ ধ্যান : ইন্দ্রিয়ানুভূতি থেকে আধ্যাত্মিক জ্ঞানের
পথ। তিনি ধ্যানকে ইন্দ্রিয় উপলব্ধি বা প্রত্যক্ষন (যা সকল গবেষণামূলক বিজ্ঞানের ভিত্তি) থেকে অবধারণ বা পূর্বজ্ঞান বা অন্তর্দৃষ্টির (Cognition) স্তরে উন্নীত করতে চান। রসুলুল্লাহ (স) এই অন্তর্দৃষ্টি বা পূর্বজ্ঞানের কথাই বলেছেন ‘ইহসান’ শব্দের ব্যাখ্যায়। তিনি বলেছেন, ‘তুমি তাকে দেখতে না পেলেও তিনি তোমাকে দেখছেন- এই জেনে যখন তুমি আল্লাহর ইবাদত কর তখন তা হচ্ছে ইহসান।’গ্রন্থকার তার গ্রন্থে ধ্যান করা এবং প্রশান্ত মনে সৎচিন্তার আলোকে বিচার করার ব্যাপারে ইসলামের নির্দেশনাকে বিস্তারিত বিশ্লেষণ করেছেন। যথার্থই আল কোরআন বলে, ‘আমি একটি বিষয়ে সতর্ক করছি, আল্লাহর সামনে তাড়াও একক বা যৌথভাবে এবং চিন্তা কর ….’ (সাবা : ৪৬)। ‘আল্লাহর সামনে দাঁড়াও’ অর্থ এখানে আন্তরিকভাবে সত্যকে অনুসন্ধান করা। ‘একক বা যৌথভাবে’ অর্থ হচ্ছে সামাজিক বা ব্যক্তিগত সংস্কারের প্রভাব বা চাপ থেকে নিজেকে মুক্ত করে চিন্তা বা বিচার বিশ্লেষণ করা।অধ্যাপক বাদ্‌রী ইবাদতের একটি মাধ্যম হিসেবে ধ্যানের গুরুত্বকে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। হযরত ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ (স) বলেছেন, এক ঘণ্টার ধ্যান সারা রাত জেগে ইবাদতের চেয়ে উত্তম। অন্যান্য হাদীসবেত্তারা বলেছেন, এক ঘণ্টার ধ্যান সারা বছরের ইবাদতের চেয়ে উত্তম। আরো সুবিধা হচ্ছে ধ্যানকে বলা যায় বিন্যাস বা আকারহীন ইবাদত যা স্থান বা কাল; দৃশ্যমান বা অদৃশ্য- কোনো কিছু দিয়েই বাধাগ্রস্ত হয় না।অন্যান্য ধ্যানের সাথে বিশেষত ট্রানসেন্ডেন্টাল মেডিটেশনের সাথে যা পাশ্চাত্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে, ইসলামি ধ্যানের পার্থক্যও লেখক বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। এক্ষেত্রে তার অভিমত হচ্ছে যে, একজন মুসলমান নিজেকে নিয়ে, স্রষ্টার সৃষ্টিরহস্য নিয়ে ধ্যানে নিমগ্ন হলে আল্লাহর রহমতে অন্য ধ্যানীদের চেয়ে উচ্চতর উপলব্ধিতে উপনীত হবেন।

আল্লাহাফেজ–