পাথরঘাটা এবং তাসনীম

ফোনে আশরাফের কথা শেষ হতে না হতেই বিছানা থেকে তড়াক করে উঠে তাসনীম। না খেয়েই ঝটপট সেজেগুজে বের হয়। আকাশে মেঘ জমেছে। যে কোন মুহূর্তে বৃষ্টি নামতে পারে। এখন কী করবো? কিভাবে যাবো? নাহ কথা দিয়েছি যেতেই হবে। তার সাথে দেখা করতেই হবে। পাথরঘাটা যাওয়ার ব্যাপারে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল তাসনীম।
আশরাফ কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে বসে সামনে দিয়ে বয়ে চলা নদীর দিকে আনমনে তাকিয়ে আছে। আজ স্বপ্নঘেরা কাঙ্খিত সেই দিন। ভাবতেছে প্রিয়া কখন আসবে। কখন দেখা হবে। অপেক্ষার প্রহর যেনো শেষ হতে চায় না।
তাসনীমকে দেখে মনে হচ্ছে যেনো গোলাপ কাননে সদ্য গজানো ফুলের কলি। তরতাজা লাল গোলাপের দীপ্তি অঙ্গজুড়ে। বেশ আকর্ষণীয়, অপূর্ব সুন্দরী, প্রখর মেধাবী। সে এবার এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছে।
আশরাফ প্রখর মেধাবী। ওর দক্ষতা, যোগ্যতা ও মেধার কারণে এলাকার বিভিন্ন সামাজিক, অনুষ্ঠানে যেতে হয়। এভাবে কোন এক অনুষ্ঠানে তাসনীমের সাথে আশরাফের সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। সম্পর্কটা এমন, যেনো বিনিসুতার মালা। কেউ কাউকে ছাড়তে পারেনা। একজনকে ছাড়া অপরজনকে কল্পনাই করা যায় না। দু’জনের মাঝে বয়সের সামান্য পার্থক্য থাকলেও মনের মাঝে কোন পার্থক্য নেই।
তাসনীম পাথরঘাটায় এসে একগাল হাসি দিয়ে আশরাফকে উষ্ণ অভিবাদন জানায়। এমন হাসি মুখের দিকে সারা জীবন চেয়ে থাকা যায়, এই হাসি জীবনেও ভোলা যায় না। আশরাফ ওর হাতে একটি গোলাপ দিয়ে বলল, ‘আই লাভ ইউ’। তাসনীম লজ্জা পেলো। ও আশরাফের গালটা ছুঁয়ে বলল, আমিও। সেকেন্ডের একটি স্পর্শ আশরাফের সূক্ষè অনুভূতিকে ভীষণভাবে নাড়া দিল। আশরাফও লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে আছে। দুরুদুরু বুকে তাসনীমের হাত ধরে। এই প্রথম কোনো নারীর হাত ধরে, পাশে বসে, গন্ধ শুঁকে, ছুঁয়ে দেখে আশরাফ।
এই পাথরঘাটা তাদেরকে স্বচ্ছ অতীতে টেনে নিয়ে যাচ্ছে দূর্বার গতিতে। মনে পড়ছে এর আগে ২ বার এখানে আসার বিষয়টি। প্রায়ই স্মৃতি বিজড়িত ঘটনাগুলি জীবন্ত হয়ে ধরা দেয় তাদের মনে।
ঈদের পর দু’জনের সাক্ষাৎ হওয়ায় একে অপরকে বখশিশ দেয়। সাথে নীল খামের চিঠিও। দু’জনে মনের আনন্দে হাতে হাত রেখে হাটতে থাকে। নদীর পারে সাদা সাদা কাশফুল, সাড়ি সাড়ি ইঞ্জিন চালিত নৌকা, জেলেদের মাছ ধরা, পানকড়ির মাছ শিকার, দক্ষিণের দিকটায় বসে থাকা মাছরাঙাটির টুইট টুইট শব্দ, নদীর উপর নীল আকাশে রংবেরঙ্গের পাখি উড়া, উথাল-পাথাল ঢেউ এসব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও রূপলাবণ্য দেখে দু’জনই মুগ্ধ। ওপাড়ে দেখা যাচ্ছে বিস্তীর্ণ প্রান্তর। ধানের শীর্ষে মৃদু দোলা দিয়ে যাচ্ছে স্বর্গীয় বাতাস। দেখে মনে হচ্ছে কোনো শিল্পীর তুলিতে আঁকা বিমূর্ত ছবি। পাঁকা ধানের গন্ধে ভরে গেছে চারপাশ। গ্রীষ্মের চিরচেনা রূপ অকৃপণভাবে বিলিয়ে দিচ্ছে এ ধরায়। দু:খভরা যে কোনো মানুষ যদি প্রকৃতির এ রূপে অবগাহন করতে পারে পরিপূর্ণভাবে, তাহলে তার দু:খ কষ্ট উধাও হয়ে যাবে। সেখান থেকে চলে আসার পর দু’জনেই ভাবল বেশ ভালই কাটছিল মুহূর্তগুলো। তখনও আশরাফ বুঝতে পারেনি সামনে কতটা অমসৃণ পথ অপেক্ষা করছে।
একদিন স্বপ্নে দেখি তাসনীম আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসছে। খুশিতে আমার শরীর কাঁপতে শুরু করল। সন্ধায় পেয়ারা গাছের নিচে দাড়িয়ে দাড়িয়ে ওর সাথে অনেক গল্প করলাম। রাতে আমার রুমেও নিয়ে গেলাম। যেখানে আমি পড়াশুনা ও সাহিত্যচর্চা করি সেখানে। খাটের উপর বসে দু’জন চুপচাপ একে অপরের দিকে অপলক নেত্রে তাকিয়ে আছি। কেমন যেনো এক ভাল লাগার মতো অন্ধ আবেগ। আমরা মুহূর্তে ভুলে গেলাম পৃথিবীর সব ক্লেদ ঘৃণা। ভালোবাসায় সিক্ত হলাম। কিন্তু জীবন যেনো কেমন। মানুষ ভাবে এক আর হয় আরেক। ৫ মিনিট পর বেরিয়ে আসি বিড়াল পায়ে গলাগলি করে। তাসনীম আমার বুকে হাত রেখে কথা দিল আমাকে কোন দিন ভুলবেনা, কষ্ট দিবেনা ও যত বাধাই আসুক আমাকে ছেড়ে কোথাও যাবে না। বাহির থেকে জানালা দিয়ে আমি আবারও গল্প জুড়ে দিলাম। এক পর্যায়ে কোনো কারণে তাসনীম কষ্ট পাওয়ায় আমার চোখের কোণে জমা থাকা ক ফোটা পানি মাটিতে পড়ল। কোন মেয়ের ভালবাসা অর্জনের জন্য জীবনে এই প্রথম কান্না। ও আমার চোখের জল আলতো হাতে খুব যতœ করে মুছে দিচ্ছে। আমাকে ক্ষমা করে দেয়ায় এবং তাসনীমের নরম হাতের ছোঁয়ায় কান্না থেমে যায়। তখনই বোঝলাম ও আমাকে কতটা ভালবাসে। ওর মার্জিত রুচি, তীক্ষœ বুদ্ধি, সংযত ভাষা, বিনীত ব্যবহার মোটকথা ওর আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বে আমি সম্মোহীত হই। ওর গুণে মুগ্ধ হয়ে সিদ্ধান্ত নেই যে করেই হোক ওকে আমার জীবন সাথী করা চাই। দিনে কয়েকবার তাসনীম আমাকে ফোন দিত। সে কী মধুর আলাপ। প্রতি পরতে পরতে ভালোবাসার অপরূপ প্রকাশ। চিঠির মাধ্যমে আমরা একে অপরের কাছাকাছি আসতে পারা। মোবাইলের মাধ্যমে আমাদের আবেগ, অনুভূতি, ভালোবাসা গভীর থেকে গভীরতর হওয়া। সেদিন তুচ্ছ বিষয় নিয়ে কথা কাটাকাটি হয়। ও সোজাসাপ্টা জবাব দিল তোমাকে আমি আজ থেকে মুক্ত করলাম, ছেড়ে দিলাম। ভিরমি খাওয়ার জোগাড়, হঠাৎ কি হতে কি হয়ে গেলো আমি কিছুই বোঝলামনা। চারদিক অন্ধাকার হয়ে গেলো। সুখের গগনে দেখা দিল কালো মেঘের ঘনঘটা। কষ্টে চোখ ভিজে গেলো। কী উত্তর দিবো? হারাবার ভয় আছে বলেই হয়ত পৃথিবী এত সুন্দর। আমি বললাম, পাওয়ার সুখের চেয়ে হারানো দু:খে ভালোবাসাকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করা যায়। সব অপ্রাপ্তি, অপূর্ণতা ও ব্যর্থতা সত্ত্বেও আমি হতাশ নই, কারণ আগুনের দরিয়া সাঁতরে স্বপ্ন সম্ভাবনার শান্ত-শীতল দীঘিতে অবগাহন করার অভিজ্ঞতা রয়েছে আমার। অস্থির হৃদয়টা কেঁদে ওঠে তাসনীমকে নিজের করে পাওয়ার জন্য। কিন্তু চেষ্টার ফল ব্যর্থ ভেবে একাকিত্ব জীবন বেছে নেই। এর পর শেষ বারের মতো ওর সাথে দেখা করি। ওকে নিয়ে আমার রচিত একটি গল্প প্রিয়জনে প্রকাশিত হওয়ায় উপহার হিসেবে দিয়ে বিদায় নেই। কোনোমতে পরিবেশটা ম্যানেজ করে নিজের ভেতরের কষ্টকে দমিয়ে রাখি। আর পিছনে ফিরে তাকাইনি। অনেক মন খারাপ করে জনমের মত ওর ইচ্ছায় আমার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তিটিকে বিদায় দিয়ে আসি। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে আমার বুক চিরে। মহা ধুমধামে ওর বিয়ের আয়োজন চলছে। ভালোবাসার মানুষটি বধূর সাজে অন্যের ঘরে চলে যাচ্ছে। ভাবতেই গা শির শির করে উঠে। শুধু ওর পরিবারের সুখের কথা চিন্তা করে আমার সুখকে তুচ্ছ জ্ঞান করেছি। সত্যি আমি তাসনীমের প্রেমে এতটা পাগল ছিলাম যে, তখন ও যা বলতো আমার কাছে মনে হতো এটাই পৃথিবীর অনেক বড় সত্য। ভালোবাসা কী? আমি জানতাম না। আজ আমার মনে হচ্ছে ভালবাসা মানে দু’টি মনের মিলন। দু’টি দেহের একটি আত্মা! একই সাথে মিশে যাওয়া। আমি যে ওকে ছাড়া একটা দিনও থাকতে পারি না। সে কথা কি ও জানতো না। তবে কেনো চলে গেলো অন্যের কাছে এভাবে—
সেসব স্মৃতি আমাকে শুধু তাড়া করে বেড়ায়। রবি ঠাকুরের ভাষায়, সখি ভালোবাসা কারে কয়, সেকি শুধুই যাতনাময়। রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর কথায়, ভুলে যাবো বলে এত দূর আসা তবু ভুলে গেছি কিন্তু ভুলে থাকতে পারিনি।
ওকে ছাড়া আমার এ জীবন শূণ্য মরুভূমির মতো। ওর পাঠানো ইনবক্সে পুরনো এসএমএস পড়ি। চোখে জল ধরে। ঠোঁট কাঁপে। ভালোবাসার ফুলগুলো দাগ রেখে যায়। গল্প হয় অন্যের। রোমিও-জুলিয়েট, লাইলী-মজনু, শিরি-ফরহাদ, রাধা-কৃষ্ণ, কিংবা মমতাজ-শাহজাহানের মতো। প্রেম ভালোবাসা দিয়েই পৃথিবীতে এরা প্রিয়জনকে পাওয়া না পাওয়ার মাধ্যমে ইতিহাস গড়ে গেছেন।
সবই আছে স্মৃতির আঙ্গিনায়। শুধু তাসনীম নেই। অর্থহীন পড়ে থাকে জীবন। এখনও আমি খুঁজে বেড়াই ওকে আমার মাঝে। ওর দেয়া চিঠি ও ছবিগুলি বুকে জড়িয়ে শুয়ে থাকি। বিধাতার অমোঘ নিয়মকে মেনে নিয়েছি।
রাতে আশরাফের মন খারাপ দেখে বুঝতে পেরে ওর আদুরে ছোট বোন মাকছুদা জিজ্ঞেস করে, ভাইয়া তোমার কি হয়েছে আমার কাছে বল। অনেক পিড়াপিড়িতে বলতে বাধ্য হয়। ঘটনার বর্ণনা শুনে মাকছুদা কান্নায় ভেঙে পড়ে।
আশরাফ মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছে। বিচ্ছিন্নতার নির্মম বাস্তবতা ওর কষ্টের মাত্রা বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। ঠিকমত খাওয়া-দাওয়া করছে না। সারাক্ষণ দরজা-জানালা বন্ধ করে ঘরের ভেতর মনের মানুষকে নিয়ে গল্প লিখে আর শুয়ে থাকে। কারো সাথে কোন কথা বলে না। শুধু নির্জনে বসে তার অতীত স্মৃতি রোমন্থনে মগ্ন থাকে। কোনো কিছুই ওর চিন্তায় ছেদ পড়ছেনা।
ডাক্তার দেখানো হলো ওকে। ডাক্তার বলল, ছেলেটি মানসিক দুশ্চিন্তার মধ্যে আছে। তাই ও রাতে ঘুমাতে পারে না। ঠিক মতো ঘুম না হলে কিডনির সমস্যাই বেশি হয় এবং অতিরিক্ত রাত জাগার কারণে ও মারাও যেতে পারে। আশরাফ এখন যে অবস্থায় আছে, ও যেকোনো সময় স্ট্রোক করতে পারে।
অতিরিক্ত রাত জাগার কারণে ও মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে। যে করেই হোক আশরাফকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে। ডাক্তার উপদেশ দিয়ে চলে যায়।
মতিচ্ছন্নের মতো ভোঁভোঁ মাথায় কয়েকদিন এলোমেলো পথ খুঁজতে লাগল আশরাফ। একদিন ও কোথায় যেনো গেলো আর ফিরে এল না।

ব্যবস্থাপনা সম্পাদক, মাসিক বিক্রমপুর

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s

%d bloggers like this: