বড় ভাইয়ের জুতা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা কোথাও। তার চিৎকার-চেচামেচিতে আজ ঘুম থেকে একটু আগেই উঠতে হল। রীতিমতো আজও প্রথমেই মোবাইলটি চেক করি। সহসা মাথাটি চক্কর দিয়ে উঠল। বিছানা ছেড়ে তড়াক করে উঠে পড়লাম। অসংখ্য মিসড কলের মধ্যে শুধু সানজিদারই ১৩ টি। সাধারণত এতগুলি কল দেয়ার মানুষ সানজিদা নয়। নিশ্চয়ই আজ কোন বিপদ-আপদ পতিত হয়েছে, জরুরী প্রয়োজন অথবা কোন দু:সংবাদ আছে। অনেক অজানা সঙ্কা, ভয় নিয়ে কল দিতেই অন্য প্রান্ত থেকে জেদী ও অভিমানী কন্ঠ ভেসে উঠল। ৯ টা ৩০ মি. এর মধ্যে কুচিয়ামোড়া আসা চাই নয়ত তোমার খবর আছে। কথাটি বলেই সংযোগটি আচানক কেটে দিল। গোঁ ধরায় আমার কোন কথাই শোনলনা। প্রবোধ দেয়ার সময়, সুযোগ ও সাহস সবই হারিয়ে ফেললাম। ওর ছোট ছোট অভিমান, হাসি, কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে কথা বেশ ভাল লাগে। তবে আজ ভিরমি খাওয়ার জোগাড়; বোঝলামনা কি হয়েছে। কিছুদিন ধরে শুনছি ওকে ওই কলেজের ভিপি ডিস্টার্ব করে আসছে প্রতিনিয়ত। সেই চিন্তা-ভাবনায় আশা আর আশঙ্কার দোলাচলে উত্তেজনার পারদ উঠানামা করছে। যে করেই হোক আজ ওর আবদার রক্ষা না করে নিস্তার নেই।
কি আর করা ঝোঁকের মুখে ও আবেগের তোড়ে বাধ্য হয়ে ঝটপট প্রয়োজনীয় কাজ- গোসল, খাওয়া-দাওয়া সেরে, তৈরি হয়ে এক প্রিয় ভাই মাসুদকে নিয়ে মটর সাইকেল যোগে রওয়ানা দেই। গন্তব্যস্থলে নির্ধারিত সময়ে আগে ৯ টা ২০ মিনিটেই আমরা চলে আসি।
সানজিদার সাথে দেখা করার অভিলাষ বহুদিন ধরেই হৃদয়ে পোষণ করছি। কোন সময়-সুযোগ, কুল-কিনারা, উপলক্ষ খোঁজে পাচ্ছিনা। ঠিক হল আমার জন্মদিনে সাক্ষাৎ হবে। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস এবার আমার জন্মদিন উদযাপনই হয়নি শুধু ওর আম্মুর অসুস্থাতার দরুন। সানজিদা আমার সবচেয়ে কাছের মানুষ। বাবার বন্ধুর মেয়ে হওয়ার সুবাদে আমাদের বাড়িতে আসা যাওয়া। সেই থেকেই ওর সাথে বেশ সখ্য গড়ে উঠে আমার। বয়সের ব্যবধান হলেও সানজিদার সাথে আমার বেশ বন্ধুত্ব সম্পর্ক। ওকে এত বেশি ভালবাসি যা ভাষায় প্রকাশ করা যাবেনা। সানজিদাও আমাকে এত বেশি মিস করে যা ব্যাখ্যা করা অনাহুত। ও ক্লাশের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্রী। সানজিদার কলেজের অধ্যক্ষসহ সমস্ত শিক্ষক ওকে ব্যাপক আদর-¯েœহ করে ভালবাসে। পরীবারের সবাই বুদ্ধিমতি হওয়ায় ওর প্রতি বেশ যতœবান। বন্ধুমহলেও বেশ জনপ্রিয়তা ও ব্যাপক পরিচিতি এনে দেয় সানজিদার আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের জন্য। ওকে একনজর দেখে যে কেউ চোখ ফেরাতে পারেনি এবং পারবেও না; আমার বিশ্বাস এমন। তাছাড়া অকৃত্রিম ভালবাসা, ¯েœহ-প্রীতি হৃদয় উজার করে দিবে বৈকি! যদিও খুব ফর্সা নয়। ওর নিটোল ধড়টি বেশ লম্বা নয়। চেহারায় যাদু আছে নি:সন্দেহে। মায়াবীনী ও উজ্জল শ্যামবর্ণের চেহারা। ওর কন্ঠে গান শোনলে যে কেউ পাগল হয়ে যাবে। বয়স বেশি নয়, মাত্র ১৭ বছর। মালখানগর কলেজের ইন্টার পরীক্ষার্থী। ওর এত রূপ ও গুণের অপূর্ব সমাহারের কারণে এত অল্প বয়সে এত মানুষের মন কাড়ছে যার ইয়ত্তা নেই। মাসুদ মন্ত্রমুগ্ধের মতো আমার কথা শোনছে। কি আর করা ঘড়ির কাটা ঠিক জায়গায় এখনও নড়ছেনা, সানজিদাও আসছেনা। ওর প্রতি আমার হৃদয়ে অনেক টান, ভালবাসা, প্রীতি সেই ছোটবেলা থেকেই। বর্ষায় আমাদের বাড়িতে আসলে বিকেল হলেই দুজনে গল্প জুড়ে দিতাম। বিলের ধারেও নৌকায় চড়ে বেড়িয়ে পড়তাম রং-বেরঙয়ের শাপলা তোলতে। শাপলা দিয়ে কত কিসিমের যে আংটি, কানের দুল ও মালা গাঁথতে জানতো এক্ষেত্রে ওর জুড়ি মেলা ভার।
সন্ধায় পড়তে বসলেই দ্বিধাহীন চিত্তে গলা খাঁকারি দিয়ে নিজের উপস্থিতি জানান দিত। মাঝে মাঝে হিহি করে দুই গালে টোল নিয়ে নির্দ্বিধায় চলে আসত একদম আমার পড়ার টেবিলে। আমিও নিরুপায় হয়ে ওর সব কান্ড সহ্য করতাম। নিজেই আমার আর্ট পেন্সিল নিয়ে যাচ্ছেতাই আঁকিঝুকি করত। একদম আমার ন্যাওটা হয়েছিল বিধায় এমনটি করেছে, পরে বুঝেছি। আজ সেই মিষ্টি, আদুরে, চঞ্চল, মিশুক, সুবোধ ও প্রিয় মানুষটি অনেক বড় হয়েছে। আমাকে তিক্ত-বিরক্ত করতে ঘন ঘন বেড়াতে আসেনা। গল্প করেও সময় নষ্ট করে না। ফুরসৎ কই? নিজেই গল্প লেখা শিখেছে। স্থানীয় অনেক পত্রিকায় এখন ওর লেখা সম্পাদকরা স্বাচ্ছন্দে প্রকাশ করছে। মোট কথা সানজিদার জীবনের মোড় ঘুরে গেছে। সম্ভাবনাময়ী লেখিকা, গল্পকার ও ছড়াকার হয়ে উঠেছে আমার সাথে পাল্লা দিয়ে। সবই সম্ভব হয়েছে ওর স্বপ্ন, আনন্দ-আশা, চেষ্টা-সাধনা, ত্যাগ-মহিমা, আগ্রহ, জ্ঞান ও প্রজ্ঞার কারণে। বছরে ২-১ বার আসে আমাদের বাসায়। যতই সানজিদার গল্প করছি ততই মাসুদ আবেগী হয়ে ওকে দেখার জন্য উতালা হয়ে উঠছে।
আচমকা সানজিদার বান্ধবী মোরশেদাকে সাথে নিয়ে হাস্যজ্জল বদনে ঠিক আমাদের দিকেই এগিয়ে আসছে। আমরা তো আনন্দে গদগদ। চোখে কাজল দিয়ে আসাতে আজ ওকে অপূর্ব লাগছে। ওমা একি! সানজিদার হাতে র্যাপিং পেপারে মোড়ানো উপঢৌকন! ভিতরে কি আছে দেখে কারো বোঝার কোন জো নেই। আমার জন্মদিনে সানজিদা সরাসরি উইশ করতে পারেনি। সারপ্রাইজ দেয়ার জন্যই আমাকে নিয়ে এসেছে- এই যা। একগাল হাসি দিয়ে উপঢৌকনটি আমার হাতে ধরিয়ে দেয়। অভিনব কায়দায় বলে উঠে ‘হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ’! আমিও ওর উইশ-উপঢৌকন আন্তরিকতার সহিত গ্রহণ করে অতি উৎসাহ ভরে থলির মধ্যে তা চালান করে দেই। সানজিদার মার্জিত রুচি, তীক্ষœ বুদ্ধি, সংযত ভাষা, বিনীত ব্যবহার মোটকথা ওর আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বে আমাদের মুগ্ধ করে। আমরা ওদের কলেজের পিছনের মাঠের একপাশে দাড়িয়ে নিরন্তর গল্প জুড়ে দিলাম। মাঠটির চারিদিকে সবুজ দুর্বার গালিচা। আশপাশ গাছগাছালিতে ভরা। আর ফাঁক দিয়ে আমাদের মাথায় সূর্যের আলো পড়ছিল। নিবিড় ছাড়াঘেরা পরিবেশ। মন ছুয়ে যায়।
অকস্মাৎ একপাশে চটপটিওয়ালাকে দৃষ্টিগোচর হওয়ায় সানজিদা চটপটি খাওয়ার লোভ একদম সংবরণ করতে পারলনা। ঝটিতি ৪ প্লেট পরিবেশন করার অর্ডার করল চটপটিওয়ালাকে। মাসুদ এসবের ধার ধারে নাই। আমাদের পিড়াপিড়িতে অনিচ্ছা সত্তেও কোনমতে একটি গিলে। মাসুদের অবস্থা বেগতিক দেখে সানজিদা বাঁকা ঠোঁটে হাসি দিয়ে উদারতার ভাব দেখিয়ে সাহায্যের হাত সম্প্রসারিত করে। ভারের মত ওর দুই প্লেট একাই পেটে জামিন দিতে দেখে হাসতে-হাসতে, কাশতে-কাশতে আমার দুচোখে অশ্রুধারা বয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে ফিরে নিজেকে কোনমতে সামলে নিলাম। ইতোমধ্যে সানজিদার আরো ২ বান্ধবী বিথী ও মারিয়া আমাদের আড্ডায় যোগ দিল। ওর বান্ধবীরা সমঝদার হওয়ায় হাস্যরসের মাত্রা আরো বেড়ে গেল।
হঠাৎ গল্পে ব্যাঘাত ঘটিয়ে আমার মোবাইলে রিং বেজে উঠল। কাকতালীয়ভাবে পরখ করলাম সানজিদার কলেজের ভিপি আনোয়ারের নাম্বার। আমার সাথে দেখা করতে আসছে জানায়। বলে রাখা ভাল, আনোয়ারের সাথে অনেক আগ থেকেই আমার কথা হত মাঝে মধ্যে। ছোট ভাই হিসেবে ওকে নাম ধরেই সম্বোধন করতাম। সবাইকে রেখে আনোয়ারকে রিসীভ করে নিয়ে আসি। ভিপি যে সানজিদাকে ডিস্টার্ব করে তা না জানার ভান করে আনোয়ারকে পরিচয় করিয়ে দেই- ও হচ্ছে আমার প্রিয় ব্যক্তি সানজিদা। আর ওরা হচ্ছে সানজিদার ক্লাশমেট ও বান্ধবী।
এদিকে সানজিদার ক্লাশের সময় ঘনিয়ে আসছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ক্লাশ শুরু হয়ে যাবে। এতক্ষণ মৌজে থাকায় সময় যে কিভাবে চলে গেল আমরা কেউই টের পাইনি। পরিমরি করে আমাদেরকে বিদায় দিয়ে সানজিদা চলে গেল। মূর্তির মত দাড়িয়ে ওর যাওয়ার দৃশ্য করুণভাবে প্রত্যক্ষ করতে লাগলাম। এই মূহুর্তের জন্য আমি কখনই প্রস্তুত ছিলামনা। কিছু একটা বলতে চেষ্টা করলাম। পারলাম না। গলা জড়িয়ে গেল।
আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব
Posted on 11/28/2013 by equeiqbal
মন্তব্য করুন