ঢেউ ও তার সমালোচন

বিক্রমপুর সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক পরিষদের মুখপত্র ‘ঢেউ’ নিয়েই আমার যত পর্যালোচনা ও গঠনমূলক সমালোচনা। কারো তল্পীবাহক হয়ে নয়, নিছক বাতবরণ-বাগাড়ম্বর করাও নয়, কোনো পুরস্কারের লোভেও নয়, তিরস্কারে লাঞ্ছিত হয়েও নয়, কারো সম্মানহানির উৎসবে মেতে উঠতেও নয়, সংগঠনের ১০ বছরের প্রয়াসকে নিন্দা জানাতেও নয়, নিরেট বিবেকের তাড়নায় অর্থাৎ মানবিক গুণে ত্রৈমাসিক ম্যাগাজিনের সম্পাদকের ভুল ভ্রান্তি শোধরানো ও সংবিৎ ফিরানোর অভিপ্রায়ে। কবির ভাষায় সময় তো দাড়িয়ে থাকে না- সে গড়িয়ে চলে মাড়িয়ে যায় এবং কালের আবর্তে হারিয়ে যায়। এই হারানোর ইতিহাস লেখার জন্য কেউ কাউকে নির্দেশ দেয়নি। সে আপনা থেকেই কলম তুলে নিয়ে লিখতে থাকে চলার কথা, বলার কথা, সুখ-দুঃখ, কান্না-হাসির কথা। তবে আমি আজ আমার প্রিয় বিক্রমপুরের সাংবাদিক, সাহিত্যিক, কলামিস্ট, লেখক, সমাজ ও পরিবেশ কর্মী ভাই ও বোনদের কাছে সম্প্রতি হাতে পাওয়া ঢেউ তা নিয়েই আমার যত কথা, যত আলোচনা।
যে কোন কাজে উৎকর্ষ লাভের জন্য চাই তীক্ষ্ণ মনযোগ, কাজের গুরুত্ব অনুধাবন, আন্তরিকতা, নিষ্ঠা, দায়িত্বশীলতা, দূরদর্শিতা, নিয়মানুবর্তিতা, সময়ানুবর্তিতা ও ধারাবাহিকতা। সাহিত্য ম্যাগাজিনকে অপূর্ব, অতূলনীয় ও মানসম্মত করার জন্য প্রাজ্ঞ ও বিদগ্ধদের সহযোগিতা, উৎসাহ, প্রেরণা ও উদ্বুদ্ধ করণ একান্ত কাম্য। তাছাড়া যে যে বিষয়ে কাজ করতে আগ্রহী সে কাজ সম্পর্কে তার বিশেষ বুৎপত্তি ও যথেষ্ট অভিজ্ঞতার প্রয়োজন। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে সৃজনশীনাতার ক্ষেত্রে তার কোনমতেই নিজে নিজেই অভিজ্ঞ বনে যাওয়ার অবকাশ নেই। অন্যথায় সে বিষয়ে দক্ষ, যোগ্য ও অভিজ্ঞদের অনুসরণ, অনুকরণ করে, পরার্শ নিয়ে ও তাদের সাথে মিশে সেই শূণ্যতা পূরণ করার অবারিত সুযোগ রয়েছে বলে মনে করি। নিয়মিত পাঠভ্যাস যে কোন সম্পাদক, সাহিত্যিক, কলামিস্ট, লেখক ও ভাবুকের অজ্ঞতা, ভুল-ভ্রান্তি ও ধারণার অস্পষ্টতাকে দূর করে। কোন কিছুকে আরও সুখপাঠ্য ও চমৎকার করার জন্য অবশ্যই একগুঁয়েমী, আলস্য, অধৈর্য, তারাহুরাভাব, লোভ, হীনমন্যতা, দাম্ভিকতা, ভয় ও গ্রন্থবিমুখতা ত্যাগ করতে হবে।
চির সত্য কথা হল কুরআন ছাড়া পৃথিবীতে নির্ভুল ও নিখুত বলে কিছু নেই। তবে কিছু কাজে দৃষ্টিগোচর হওয়ার মত কিছু ভুল না শোধরালেই নয়। বিষয়টির ব্যাখ্যা শুরু করতে চাই। শুরুটি ঠিক বুকের ভেতর দুরু দুরু শব্দে সঙ্গীতের ধ্বনির মতো বেজে উঠে।
ঢেউ এর আগস্ট সংখ্যাটি হাতে পেয়ে সযত্নে সোকেসে রেখে দেই। আত্মার দংশনে, বিবেকের তাড়নায় ও লেখালেখি চালিয়ে যাওয়ার অভিলাষে ইচ্ছা-অনিচ্ছায় বিরতি নিয়ে কয়েকবারে পুরো সংখ্যাটিই ধৈর্যসহকারে পড়ে শেষ করি। ম্যাগাজিনটির সাথে গত দুই বছর ধরে পরিচিত; তাও সদরে গিয়ে নিজ উদ্যোগে খুঁজতে থাকি বিক্রমপুর থেকে কি কি পত্রিকা, সাহিত্য সাময়িকী ও ম্যাগাজিন বের হয় সেই সুবাদে। আমার ব্যক্তিগত সমীক্ষা, গবেষণা ও অনুসন্ধানে প্রায় ২০টি পত্রিকার নাম বেরিয়ে আসে, যার মধ্যে অনেকগুলিরই রেজিস্ট্রেশন নেই। তার মধ্যে রেজিস্ট্রিকৃত মাসিক বিক্রমপুর নিয়মিত বের হচ্ছে প্রতিষ্ঠাকালীন ১৯৮১ সাল থেকে আজ অবধি। তিনমাস ধরে এই পত্রিকাটি ৬টি উপজেলার সরকারী সব বিভাগ, কিছু চিহ্নিত রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ, সাংবাদিক, লেখক, সাহিত্যিক, সমাজ কর্মী, পরিবেশ কর্মী, ব্যবসায়ী, মাসিক বিক্রমপুরের গ্রাহক ও এজেন্টদের হাতে পৌঁছানো হয়। মুন্সিগঞ্জের কাগজও নিয়মিত বের হয়ে শুধু ৬ উপজেলার টিএনও ও থানার গন্ডি পর্যন্ত সিমাবদ্ধ। এছাড়া বিভিন্ন অকেশনে ব্যপকহারে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, ব্যবসায়ী ও বিজ্ঞাপনদাতাদের হাতে দৈনিকটির সংখ্যা চলে যায়। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, এদুটি ছাড়া মুন্সিগঞ্জ থেকে নিয়মিত কোন পত্রিকা, সাহিত্য সাময়িকী বা ম্যাগাজিন বের হয়ে সব উপজেলার দোরগোড়ায় পৌঁছে এমন তথ্য আমার কাছে অনুপস্থিত।
সংখ্যাটি পড়ে প্রথমেই আমার কাছে কয়েকটি ভুল চিহ্নিত হয়। মাসিক বিক্রমপুরের লেখক ও পাঠকদের সাথে তা ব্যক্ত ও শেয়ার না করার লোভ একদম সামলাতে পারছিনা। আর তা হল- ১.ভাল মানের স্থানীয় লেখক (সৈয়দ টিপু সুলতান, নূহ-এ-আলম লেনিন, এমদাদুল হক মিলন প্রমুখ), সাহিত্যিক ও সাংবাদিকের লেখা অনুপস্থিত, ২.ভালভাবে যাচাই-বাছাই ও সম্পাদনা না করেই সংখ্যাটি বের করা হয়েছে, ৩.অন্য জায়গায় প্রকাশিত লেখা এখানে হেডিং পরিবর্তন করে ছাপানোর নজির রয়েছে ও ৪.বানানের ক্ষেত্রে কিছু প্রিন্টিং ও এডিটিং ভুল পরিলক্ষিত হয়েছে। চলতি সংখ্যাটির মান কমানোর পিছনে সবগুলি কারণেরই কমবেশি অবদান রয়েছে।

একজন সম্পাদকের জন্য খুবই লজ্জার বিষয় হচ্ছে অন্য পত্রিকার লেখা নিজেরটিতে প্রকাশ করা। একজন স্থানীয় সম্পাদক ও প্রকাশক হিসেবে নিজ উদ্যোগে স্থানীয় সব পত্রিকার খোজ-খবর নিজ স্বার্থে রাখা উচিত বলে আমি মনে করি। পাঠকের দৃষ্টিতে এখানে তার অনভিজ্ঞতা, অদক্ষ্যতা, অযোগ্যতা, অপরিণামদর্শিতা ও অজ্ঞতাই স্পষ্ট প্রতিয়মান হয়ে উঠেছে। প্রতিনিয়তই যদি এমন হতে থাকে তাহলে তার উদ্দেশ্য পুরোপুরি উবে যাবে। অভিজ্ঞতা অর্জনের অন্যতম উপায় হচ্ছে ভুল (নিজের ভুল অথবা অন্যের ভুল) থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা। আমরা জানি ছোট ছোট ভুল থেকে একটি সময় বড় কোন ভুল বা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। আর ব্যর্থতা হল সফলতার যাত্রাপথে একটু বিরতি মাত্র। অনেকে বলেন ব্যর্থতাই সফলতার ভিত্তি। তবে স্বপ্নচারীদের থেমে গেলে চলবেনা। ধৈর্যসহকারে এই সমস্ত প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করে সফল হওয়াই একজন দক্ষ সম্পাদকের কাজ।
সাহিত্য সাময়িকী ঢেউ এর বর্তমান আগস্ট-১৩ সংখ্যায় লেখকের দৃষ্টিতে মাত্র তিনটি লেখা চমৎকার হয়েছে যা অস্বিকার করার জোঁ নেই। যথা- ১.সালাম আজাদের ভাঙ্গামঠ ও গুরু-শিষ্য সংবাদ, ২.শ্রীনগরের লালা বংশ ও ৩.একটি নষ্ট রাতের কষ্ট । ৬২ পৃষ্ঠার ম্যাগাজিনের ভিতর ৪৮ জন নবীন ও প্রবীণ লেখকের ৫৫ টি লেখা স্থান পেয়েছে। এ সংখ্যায় ২ জন লেখককে ১৮ পৃষ্ঠা না দিয়ে, ৯ জন লেখককে ২ পৃষ্ঠা করে ৯ টি বাছাইকৃত লেখা দেয়া হলে ম্যাগাজিনটির মান আরও সহজবোধ্য, প্রাঞ্জল, রুচিশীল, মার্জিত ও উন্নত হত। ম্যাগাজিনটির স্বকীয়তা বজায় রেখে সম্পাদকের সদিচ্ছায় ভাল লেখে এমন আরো লেখকের লেখা সন্নিবেশিত করা যেত। লেখার সাথে যুৎসই চিত্র বিদ্যমান থাকলে পাঠক সেটি না পড়ে এরিয়ে যাওয়ার দু:সাহাস করত না। সমালোচকের ধারণা মতে সম্পাদকের হীনমণ্যতা না থাকলে পত্রিকাটির গ্রহণযোগ্যতা আরো বৃদ্ধি করা যেত। যেহেতু বিক্রমপুর সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক পরিষদের পক্ষ থেকে বের হচ্ছে তাই ম্যাগাজিনটি কলেবর বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে এই পাঠকের পক্ষ থেকে পরামর্শ হল এখানে স্থান পাওয়া প্রবন্ধ, কবিতা, আলোচনা, ছোট গল্প, ইতিহাস ও উপন্যাসের সাথে যুগের চাহিদার প্রেক্ষিতে নাটক, সায়েন্স ফিকশন, রম্য রচনা, কৌতুক, ধাঁধাঁ, ছোটদের আঁকিঝুকি, প্রতিবেদন, তথ্যচিত্র, নিবন্ধ, কলাম, বিক্রমপুরের বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব ও ঐতিহ্য (যেমন- খোদাই সিন্নি, পিনিস, পালকি, ঢেকি, গস্তি নৌকা, পোড়াগঙ্গা, রজত রেখা, কাজল রেখা ইত্যাদি) সংরক্ষণের জন্য নিয়মিত ঢেউ এ তুলে ধরা উচিত।
ঢেউ এর সম্পাদক ও মাসিক বিক্রমপুরের পাঠকবৃন্দ আমাকে ভুল বুঝে থাকলে ক্ষমা করবেন। আমি চাই মুন্সিগঞ্জ থেকে প্রকাশিত প্রত্যেকটি সাহিত্য সাময়িকী, ম্যাগাজিন ও পত্রিকা নির্ভুল, নিখুত, মার্জিত, মানসম্পন্ন ও সর্বজন গ্রহণীয় হয়ে উঠুক।
২০০৩ সাল থেকে আমি বন্ধুদের খ্যাপানোর জন্য ব্যঙ্গাত্মক কিছু সাহিত্যিক কর্ম খেলাচ্ছলে শুরু করি। সেই থেকে আমার বন্ধুদের মধ্যে অনেকে আজও কবি/সাহিত্যিক বলে সম্বোধন করে। তৎকালে আমার লেখা দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকা, সাপ্তাহিক সোনার বাংলা, মাসিক আলোর দ্বীপ, মাসিক আদর্শ নারী, মাসিক কিশোর কন্ঠ ইত্যাদিতে প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমানে আমি দৈনিক সংবাদে একজন প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত আছি। এছাড়া একটি অনলাইন পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টারের দায়িত্ব পালন করছি মাত্র। বিক্রপুরের ঐতিহ্যবাহী মাসিক বিক্রমপুরে কাজ করে অনেক কিছু নতুন করে শিখতে হয়েছে, যেটা আমার অভিজ্ঞতার ঝুলিকে অনেক সমৃদ্ধ করেছে।
বেগার পর্যালোচনা, বিশ্লেষণ ও পরামর্শ দেখে অনেকেই দাঁত কেলিয়ে হি হি করে হাসবে তবুও সেসবে পাত্তা দেয়ার মত মানসিকতা মাসিক বিক্রমপুরের ব্যবস্থাপনা সম্পাদকের একদম নেই। তবে এই লেখা যদি ঢেউ নতুন পথে এগিয়ে নতুন নতুন সংখ্যা এখন থেকে বের হয়ে নিয়মিত সর্বস্তরের পাঠকের হাতে পৌঁছে তাহলে এর মাঝেই আমার স্বার্থকতা খুঁজে পাব।

-ব্যবস্থাপনা সম্পাদক, মাসিক বিক্রমপুর (০১-১০-২০১৩ইং) ঈদ সংখ্যায় প্রকাশিত

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s

%d bloggers like this: