স্বপ্ন

সাগরকন্যা জেসিকা

নাহিদ খান, সিডনি থেকে | তারিখ: ২৬-০৫-২০১০

নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে যেমন বিশাল জনসমাবেশ তৈরি হয় সিডনি অপেরা হাউসের সামনে, অনেকটা সেই রকম জনসমাবেশের সৃষ্টি হয়েছিল সিডনির সমুদ্র উপকূলে, যেন সাগর থেকে উঠে আসা কোনো নতুন সূর্যকে অভিবাদন জানাতে। এ সূর্যের নাম জেসিকা ওয়াইসন। বয়সটা তখনো ১৬-র ঘরে, ১৭ ছুঁই ছুঁই করছে। ১০ মিটার লম্বা ইয়ট (একধরনের জলযান) চড়ে একা এ মেয়েটি ২১০ দিনে সমুদ্র-জয় করে এসেছে, যার সঠিক পরিমাপ প্রায় ২৩ হাজার নটিক্যাল মাইল। জেসিকার এই সমুদ্র-জয় শুধু সাগরপথে পৃথিবী প্রদক্ষিণ নয়; বরং সূর্য যেমন অনেক আলোকরশ্মি ছড়ায়, তেমনি জেসিকার জয় উন্মোচন করে তারুণ্যের নানা সম্ভাবনার দিক।

তীরে এসেই জেসিকা সগর্বে জানাল, সে একজন অতি সাধারণ মেয়ে, যার একটা স্বপ্ন ছিল। সেই স্বপ্নে বিশ্বাস ছিল আর ছিল সাধনা। এটুকুই প্রয়োজন কোনো স্বপ্নপূরণের জন্য, কোনো বিশেষ প্রতিভার প্রয়োজন নেই। ক্ষীণকায় জেসিকার সব শক্তি ছিল তার চেতনায় আর হূদয়ে। তার কাছে সবচেয়ে পরিতৃপ্তির বিষয় হচ্ছে, সে প্রমাণ করেছে ‘টিনএজার’দের সব পরিকল্পনা এক, সংকল্প অবজ্ঞার নয়। সুযোগ দিলে টিনএজাররাও পারে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে, যা ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে বিস্ময়কর কোনো ঘটনা হিসেবে। এখনো সে মনে করতে পারে, উত্তাল সমুদ্র পাড়ি দেওয়ার চেয়েও কঠিনতর ছিল কাউকে বোঝানো যে এ কাজটি সে করতে পারবে। দুই বছর আগে যখন তার বয়স ছিল মাত্র ১৪, অনেকেই উড়িয়ে দিয়েছে জেসিকার স্বপ্নের কথা। ভেবেছে, এ আরেকটি কৈশোর-যাচিত উন্মাদনা। কিন্তু জেসিকার মা-বাবা তাঁদের মেয়েকে ভালো বুঝতেন। তাঁরা মনে মনে জানতেন, জেসিকা পারবে তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে। তাই শুরু থেকেই তাঁরা ছিলেন জেসিকার স্বপ্নসারথি। তাঁরা দিয়েছেন সম্পূর্ণ স্বাধীনতা, সমর্থন ও সহযোগিতা। এ জিনিসটাই তারুণ্যের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন, স্বপ্ন দেখার স্বাধীনতা আর সেই সঙ্গে বড়দের বিশ্বাসযুক্ত সমর্থন ও সহযোগিতা।

শৈশবে ডিসলেক্সিয়াতে আক্রান্ত এ মেয়েটির ওপর তার মা-বাবা কখনোই বিশ্বাস হারাননি। বরং প্রতিটি পদক্ষেপে খুঁজে বেড়িয়েছেন নতুন নতুন উপায়, কী করে পড়তে না পারা অসহায় শিশুটিকে সাহায্য করা যায়। এখন নির্দ্বিধায় বলা যায়, তাঁরা সফল হয়েছিলেন তাঁদের কর্তব্যে। সেই সফলতা আজ পরিবারের গণ্ডি পেরিয়ে, দেশ পেরিয়ে পৌঁছে গেছে বিশ্বের সৈকতে।

জেসিকার এই কাব্যসমতুল্য সাফল্যকে ‘ওয়ার্ল্ড স্পিড সেইলিং রেসিং কাউন্সিল’ ‘সর্বকনিষ্ঠ নাবিক’-এর রেকর্ড হিসেবে গণ্য করতে পারেনি, কিন্তু তাতে জেসিকা বিন্দুমাত্র বিচলিত নয়। তার কাছে কোনো রেকর্ড নয়, বরং সাগরযাত্রাটি ছিল বড়। সে দেখেছে পর্বত-সমান ঢেউ। মোকাবিলা করেছে উত্তাল সাগরকে অথবা কখনো শান্ত সমুদ্রে জীবনকে নতুনভাবে উপলব্ধি করেছে। এসবই তার বড় পাওয়া। আমাদের মনে পড়বে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘আকাশেতে আমি রাখি নাই/ মোর উড়িবার ইতিহাস/ তবু উড়েছিল/ এই মোর উল্লাস’।

অস্ট্রেলিয়ার গণমাধ্যমগুলো যেন যথেষ্ট প্রতিবেদন তৈরি করতে পারছে না। প্রতিদিন জেসিকার তীরে ফিরে আসাটাই বড় খবর। কিন্তু তাতেও জেসিকা বিচলিত নয়। সে তার স্বভাবসুলভ ও বয়সসুলভ হাস্যমধুর সাবলীলতা বজায় রেখেছে।

চারদিকের অর্থের হাতছানিতে জেসিকা নিজেকে ভাসিয়ে দেয়নি। প্রতিটি দিন সে একটু একটু করে উপভোগ করছে অত্যন্ত সংযতভাবে। কোনো ফটোগ্রাফার তাকে আড়াই শ হাজার অস্ট্রেলিয়ান ডলার দিতে চেয়েছিল তার আসন্ন সপ্তদশ জন্মদিনের অনুষ্ঠানে কিছু ছবি তোলার জন্য। জেসিকা বিনয়ের সঙ্গে তা প্রত্যাখ্যান করেছে। দীর্ঘ সাত মাস পর ফিরে এসে এ জন্মদিনটি সে পালন করবে একান্ত আপনজনদের সঙ্গেই।

লেখাটি যেদিন লেখা হলো, সেদিন ছিল জেসিকার ১৭তম জন্মদিন। অসীম সাহসী, দৃঢ়সংকল্প, স্বপ্ন সার্থককারী এ সাগরকন্যাকে জানাই শুভ জন্মদিন। জেসিকার জয় হোক।

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s

%d bloggers like this: